অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।
‘খেলা’ যে একতরফা হবে, জানাই ছিল। বিরোধীদের প্রশ্ন ছিল সেই খেলার মাঠ নিয়ে। নির্বাচন কমিশনের কাছে আগাম ব্যবস্থার দাবিও জানানো হয়েছিল। ভোটের ফলের বিশদ পরিসংখ্যান হাতে নিলে দেখা যাচ্ছে, ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের বুথে বুথে ‘ভয়ঙ্কর খেলা’ হয়েছে! যেখানে দাঁত ফোটানো দূরের কথা, বেমালুম উবে গিয়েছে বিরোধীরা!
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, রাজ্যে এ বারের লোকসভা নির্বাচনে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং মনে করিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের বিপুল জয় এসেছে ‘জেনুইন ভোটে’। কিন্তু ম্যাচের স্কোরশিট সামনে রেখে বিরোধীদের প্রশ্ন, কয়েকশো বুথে অন্যেরা কেউ রানই পেলেন না— এ কী ভাবে সম্ভব? কিছু বুথে ভোট পড়ে গেল একেবারে ১০০%! ম্যাচে শাসক দলের তাকতের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও পরিসংখ্যানকে হাতিয়ার করে বিরোধীদের প্রশ্ন, ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচে’র উপরে কি আলাদা ‘শক্তি’ ভর করেছিল? তৃণমূল নেতৃত্বের জবাব, মূলত লকডাউনের পর্বে এবং অন্য সময়েও এলাকায় সাংসদ যা কাজ করেছেন, তার দৌলতেই এমন ফল।
ডায়মন্ড হারবার লোকসভা আসন থেকে তৃতীয় বার সাংসদ হওয়ার পথে তৃণমূল প্রার্থী অভিষেক পেয়েছেন ১০ লক্ষ ৪৮ হাজার ২৩০ ভোট। ওই কেন্দ্রে প্রদত্ত ভোটের ৬৮.৪৮% তাঁর ঝুলিতে। জয়ের ব্যবধান ৭ লক্ষ ১০ হাজার ৯৩০। নির্বাচনের ফর্ম ২০-র পার্ট-১ (বুথভিত্তিক) এবং পার্ট-২ (বিধানসভা ভিত্তিক) ধরে নিচু তলায় নামলে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল সাংসদ তথা প্রার্থীর ‘জনপ্রিয়তা’র কাছে দাঁড়াতেই পারেনি বিরোধীরা! মূলত ফলতা, বজবজ, ডায়মন্ড হারবার, বিষ্ণুপুর ও সাতগাছিয়া বিধানসভার একাংশে বুথে বুথে পাওয়া যাচ্ছে এমন চিত্র। আবার মল্লিকপুরের ৪ নম্বর বুথ, নপুকুরিয়ার আসিনা তাঁতিপাড়া এফ পি স্কুল বা দেবীপুরের ভাতহেরিয়া জুনিয়র বেসিক স্কুলের বুথে ভোটই পড়েছে ১০০%।
বুথভিথিক পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, ফলতা বিধানসভার মল্লিকপুর অঞ্চলের ১৭, নপুকুরিয়া অঞ্চলের ৫০, দেবীপুর অঞ্চলের ৮৮, কলাতলা অঞ্চলের ২৪০ নম্বর বুথে কোথাও সিপিএম প্রার্থী শূন্য ভোট পেয়েছেন, কোথাও ১টি। বিজেপি প্রার্থীরও একই হাল। তার মধ্যে ৫০ নম্বর বুথটিতে তৃণমূল যেখানে ৯৭১ ভোট পেয়েছে, বিজেপি ও সিপিএম দু’দলের খাতাতেই সেখানে শূন্য! নপুকুরিয়া অঞ্চলেরই একটি বুথে মোট ১০৯৪ ভোটের মধ্যে তৃণমূল ১০৮০। বিজেপির ৮ এবং সিপিএমের দুই। বজবজ বিধানসভার মায়াপুর অঞ্চলের ১১৩ নম্বর বুথে তৃণমূলের ভোট ৭১৩। সিপিএম সেখানেও শূন্য, বিজেপি দুই। ডায়মন্ড হারবার বিধানসভার পারুলিয়া অঞ্চলের ৬৬ নম্বর বুথে তৃণমূলের ঘরে ১১৫৬টি ভোট। সিপিএমের ১০, বিজেপির তিন। বিরোধীদের ভোট কোনও ক্রমে দুই অঙ্কে পৌঁছেছে, এমন বুথের সংখ্যা বিস্তর। বিষ্ণুপুর বিধানসভার ৯৬ নম্বর বুথের মতো উদাহরণ আছে, যেখানে তৃণমূল পেয়েছে ৯০৮ ভোট। সিপিএমের প্রাপ্তি ১৮, বিজেপির ১৬।
সপ্তম দফায় গত ১ জুন ভোট হয়েছিল ডায়মন্ড হারবারে। প্রতিরোধের চেষ্টায় দিনভর দৌড়োদৌড়ি করেছিলেন সিপিএম প্রার্থী প্রতীক-উর রহমান। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ভোট ‘লুট’ হয়েছে, এই অভিযোগে বিকালেই তাঁরা দাবি করেছিলেন ওই কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিল করার। ধর্না দিয়েছিলেন মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতরে। বিস্তারিত ফল দেখার পরে প্রতীক-উরের দাবি, ‘‘এটাই ডায়মন্ড হারবার ‘মডেল’! গত বার ৪২২টি বুথে বিরোধীদের ভোট ছিল না, এই রকম নানা তথ্য আমরা আগাম কমিশনে জানিয়েছিলাম। কমিশন চাইলে পর্যবেক্ষক এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীকে সক্রিয় করে এই অবস্থা ঠেকানো যেত। কিন্তু সেটা হয়নি।’’ বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ (ববি) দাসেরও অভিযোগ, এই ফল কোনও ভাবেই ‘সুষ্ঠু’ ভোটের পরিণাম নয়।
সিপিএমের বক্তব্য, মেটিয়াবুরুজ ও মহেশতলা বিধানসভায় মোটের উপরে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে। তাই সেখানে হারলেও কোনও অভিযোগ নেই। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চত্রবর্তীর মতে, ‘‘মানুষের রায় বলে যা ঘোষণা হয়েছে, আমরা মাথা পেতে নিয়েছি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যাঁকে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ বলেছেন, সেখানকার ভোট কেমন হয়েছে, বুথের হিসেব দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। এ বারের ভোটে মুখ্যমন্ত্রী আলাদা করে কৃতিত্ব দিয়েছেন অভিষেক এবং আইপ্যাক-কে। ভোটের অনেকটা এখন ‘ম্যানেজমেন্ট আর ম্যানিপুলেশন’-এ হয়ে যাচ্ছে, এটাই উদ্বেগের।’’
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, ‘‘ডায়মন্ড হারবারে ভোটের নামে ছাপ্পা হয়েছে। পুলিশ এবং আইপ্যাক মিলে এটা করেছে। গণতন্ত্রের নামে প্রহসন হয়েছে!’’ বাম জমানায় আরামবাগ লোকসভা আসনে সিপিএমের অনিল বসুর পাঁচ লক্ষের বেশি ভোটে জয় বা কেশপুর বিধানসভায় নন্দরানি ডলের প্রথম বার লক্ষাধিক ভোটে জেতা নিয়ে হইচই কম হয়নি। এখনকার বিরোধীরাও তো একই কথা বলছেন? তৃণমূলের নেতা কুণাল ঘোষের দাবি, ‘‘ওগুলো খোলাখুলি সন্ত্রাস ছিল। এখানে কাজের ফল মিলেছে। সরকারি নানা পরিষেবার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন সাংসদ। সরকারি ব্যবস্থার বাইরেও লকডাউনের সময়ে বহু ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন অভিষেক। উপকার পেয়েছেন যে মানুষ, তাঁদের ১০০%-ই তৃণমূলকে ভোট দিলে তার মধ্যে অস্বাভাবিক কী আছে?’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘বিরোধীদের ওখানে বলার কিছু ছিল না, সংগঠনও ছিল না। তারা দাঁড়াতে পারেনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy