গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এক জন প্রয়াত ১৪ বছর আগে। অন্য জন প্রায় সাত বছর গৃহবন্দি। প্রথম জনের রাজনৈতিক জীবনে শেষের দিকে শুধু উত্তরণ। তাঁর ‘ব্যর্থতা’ আপাতদৃষ্টিতে সে ভাবে দেখেনি বঙ্গ রাজনীতি। অন্য জনের জমানায় শিখর ছোঁয়া এবং সাড়ে তিন দশকের ইমারত ভেঙে পড়া চাক্ষুষ করা গিয়েছে। প্রথম জন বাংলায় ভূমিসংস্কার করেছিলেন। সফলও হয়েছিলেন। দ্বিতীয় জন চেয়েছিলেন কৃষিকে ভিত্তি করে শিল্পায়নের পথে হাঁটতে। নির্বাচনী ফলাফল বলে, তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।
প্রথম জনের নাম জ্যোতি বসু। দ্বিতীয় জনের নাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বাংলার ২৩টি কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়েছে জ্যোতি-বুদ্ধের দল সিপিএম। সেই ২৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ২২ জনের পছন্দের রাজনীতিবিদের তালিকায় কার্যত খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবকে। দু’জন বাদ দিয়ে সকলেই জানিয়েছেন, তাঁদের পছন্দের রাজনীতিবিদ অন্য কেউ নন, জ্যোতি বসু।
রাজ্য সিপিএমের ফেসবুক পেজ থেকে কয়েক সপ্তাহ ধরেই প্রার্থীদের পরিচিতিপত্র প্রকাশ করা হচ্ছিল। শনিবার সকাল পর্যন্ত ২২ জনের পরিচিতিপত্র প্রকাশিত হয়েছে। কৃষ্ণনগরের সিপিএম প্রার্থী এসএম সাদির পরিচিতিপত্র প্রকাশে ‘জটিলতা’ রয়েছে বলে খবর। তবে সে ‘জটিলতা’ একান্ত ভাবেই যোগাযোগ, সময়াভাব এবং প্রযুক্তিগত। যে ২২ জনের পছন্দের রাজনীতিকের তালিকা প্রকাশিত, তাতে দেখা যাচ্ছে ১৪ জনই বলেছেন, তাঁদের পছন্দের রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু। জ্যোতির সেই বলয়ের সামনে নিষ্প্রভ বুদ্ধদেব। মাত্র দু’জন প্রার্থী পছন্দের রাজনীতিকের তালিকায় রেখেছেন বুদ্ধদেবকে। আরামবাগের বিপ্লব মৈত্র এবং ব্যারাকপুরের অভিনেতা প্রার্থী দেবদূত ঘোষ।
জ্যোতি বসুকে যাঁরা পছন্দের রাজনীতিক বলেছেন, তাঁদের বয়সের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র রয়েছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা মুর্শিদাবাদের প্রার্থী মহম্মদ সেলিম, দমদমের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী যেমন বলেছেন তাঁদের প্রথম পছন্দ জ্যোতি বসু, তেমনই আবার তরুণ প্রজন্মের দীপ্সিতা ধর, সৃজন ভট্টাচার্যদেরও পছন্দ জ্যোতি বসুকেই। তবে কয়েক জন অন্য নেতাদেরও নাম বলেছেন। কেউ কেউ দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক হয়েছেন। যেমন দক্ষিণ কলকাতার প্রার্থী সায়রা শাহ হালিম বলেছেন তাঁর প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিউবা বিপ্লবের অন্যতম সেনানী চে গেভারা। বর্ধমান পূর্বের প্রার্থী নীরব খাঁ কার্ল মার্ক্সের নাম উল্লেখ করেছেন। বর্ধমান-দুর্গাপুরের প্রার্থী সুকৃতি ঘোষাল বলেছেন বিমান বসুর নাম। বসিরহাটের প্রার্থী নিরাপদ সর্দারের প্রিয় আবার দলের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। তবে পছন্দের পথে হাঁটেননি বোলপুরের সিপিএম প্রার্থী শ্যামলী প্রধান। তিনি বলেছেন, কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি নন, কমিউনিস্ট মতাদর্শের সবাইকেই তিনি শ্রদ্ধা করেন।
রানাঘাট লোকসভার সিপিএম প্রার্থী তথা সেখানকার প্রাক্তন সাংসদ অলোকেশ দাসের বয়স ৫৯ বছর। তিনি জ্যোতি বসুকে বাছলেন কেন? অলোকেশ বলেন, ‘‘জ্যোতিবাবু আমার কাছে অনন্য। আর কোনও শব্দ আমার জানা নেই। তাঁর সঙ্গে রাজ্য কমিটির বৈঠক করেছি। অনেক পরামর্শ পেয়েছি। তিনি অন্য উচ্চতার রাজনীতিক।’’ যাদবপুরের প্রার্থী ৩১ বছরের সৃজনের কেন জ্যোতি বসুই প্রথম পছন্দ? সদ্য এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়া সৃজন বলেন, ‘‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমাদের প্রজন্মের স্বপ্নদিশারি। এটা জ্যোতিবাবু বনাম বুদ্ধবাবুর ব্যাপার নয়। জ্যোতি বসুর ব্যাপ্তি দল, মত, রাজনীতি, রাজ্য এমনকি, কিছু ক্ষেত্রে দেশেরও সীমানা পেরিয়ে গিয়েছে। জ্যোতি বসু বিংশ শতকের প্রতীক। আমার ধারণা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেরও জ্যোতি বসুর কথাই প্রথম মনে হবে।’’ উল্লেখ্য, সৃজন তাঁর পছন্দের রাজনীতিক হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে রেখেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিংহকে। সৃজন এ-ও জানিয়েছেন, যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে (যে যাদবপুর নামের বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হতেন বুদ্ধদেব) প্রার্থী হওয়ার পর বুদ্ধদেবের স্ত্রী মীরা এবং সন্তান সুচেতনের সঙ্গেও তাঁর কথা হয়েছে। তাঁরা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
বুদ্ধদেবকে প্রিয় রাজনীতিকের তালিকায় রেখেছেন আরামবাগের সিপিএম প্রার্থী বিপ্লব। তাঁর যুক্তি, ‘‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্পায়নের যে রাস্তায় হাঁটতে চেয়েছিলেন, তা বাস্তবায়িত হলে রাজ্যে বেকারদের এই হাহাকার দেখতে হত না। তিনি সল্টলেক, রাজারহাটে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের যে নবদিগন্ত রচনা করেছিলেন তা এখনও দৃশ্যমান। সেই সঙ্গে তাঁর জীবনযাপনও রয়েছে তাঁকে প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বাছার নেপথ্যে।’’
জ্যোতি বসু স্বাধীনতার পর বাংলায় যে রাজনীতি করেছিলেন, বামপন্থীদের কাছে তা ‘মাইলফলক’ হয়ে রয়েছে। আন্দোলনের সরণি ধরেই ১৯৭৭ সালে তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া। সিপিআই ভেঙে সিপিএম তৈরির পর্বে দলের লাইনগত প্রশ্নেও তাঁর অবস্থান ছিল দৃঢ়। ফলে সংসদীয় রাজনীতি এবং সংগঠন সমান তালে করেছিলেন জ্যোতি বসু। ২০০০ সালে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার ছেড়ে দেন তুলনায় নবীন বুদ্ধদেবকে। ধীরে ধীরে বয়সের ভারে, শারীরিক কারণে ছেড়ে দেন পলিটব্যুরো এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীও। ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রয়াত হন জ্যোতি বসু। তখনও বামফ্রন্ট সরকার রয়েছে। ঘটনাচক্রে, তার পরের বছরেই বাম সরকারের পতন ঘটে। যে সরকারের মাথায় ছিলেন বুদ্ধদেব। যে বুদ্ধদেবকে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে মহাকরণ থেকে শেষ বারের মতো বেরিয়ে এসেছিলেন জ্যোতি বসু।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণবঙ্গের এক তরুণ সিপিএম প্রার্থীর কথায়, ‘‘জ্যোতিবাবু বামেদের সংসদীয় রাজনীতিতে ঈশ্বরসমান। যাঁর সাফল্যই দেখা গিয়েছে। তাঁকে ব্যর্থ হতে দেখেননি কেউ। যিনি নির্মাণ করেছিলেন। বুদ্ধ’দার ক্ষেত্রে তা নয়।’’ তিনি এ-ও বলেন, ‘‘প্রশাসক জ্যোতিবাবু অন্য স্তরের ছিলেন। বুদ্ধ’দা ভাল মানুষ। ভাল মানুষ আর ভাল প্রশাসকের ফারাক রয়েছে। আমার মনে হয়, জ্যোতিবাবু মুখ্যমন্ত্রী থাকলে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে আমাদের ওয়াটার্লু হত না।’’
বুদ্ধদেবের অন্যতম প্রিয় সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কে়জ়। তাঁর অনেক উপন্যাস বাংলায় অনুবাদও করেছেন বুদ্ধদেব। অধুনাপ্রয়াত এক সিপিএম নেতা বাম সরকার পতনের কয়েক বছর পরে ঘরোয়া আলোচনায় এক বার রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘‘বুদ্ধ’দা মার্কেজ়ের উপন্যাসের বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। যার নাম ছিল ‘বিপন্ন জাহাজের এক নাবিকের গল্প’। তিনি নিজেও বিপন্ন জাহাজের নাবিক হয়ে গেলেন।’’
সংসদীয় রাজনীতিতে বাংলায় সিপিএম যখন দৃশ্যতই বিপন্ন, তখন সেই জাহাজের বর্তমান নাবিকেরা ‘ক্যাপ্টেন’ হিসেবে বেছে নিলেন জ্যোতি বসুকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy