ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের প্রচারে এমনই হোর্ডিং দেওয়া হয়েছিল ঘাটাল শহরের বিভিন্ন এলাকায়। পরে অবশ্য সেই সব হোর্ডিং খুলে নেওয়া হয়। ফাইল চিত্র
বৈশাখের তপ্ত দুপুরে মূল রাস্তার খানিক দূরে গাছতলায় জমাটি আড্ডা চলছিল। কেউ তাস খেলছিলেন। কারও মুখে সেই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান। চলছিল জোর তর্কাতর্কি। তর্কের বিষয়, ওই প্রকল্প যদি সত্যিই শুরু হয়, তবে কার টাকায় হবে? মোদী না মমতার?
ঘাটালের সেই সীমান্ত এলাকা বলে পরিচিত হুগলি লাগোয়া গ্রাম কোমরা। দিন দুই আগেই সেখানে ঘাটালের তৃণমূল প্রার্থী দেব (দীপক অধিকারী) পথসভা করে গিয়েছিলেন। সেই জায়গায় পৌঁছতেই পরিচয় জানার পরই আড্ডাবাজদের কাছ থেকে এই প্রতিবেদকের কাছেও এল প্রশ্নটা। একজন বললেন, ‘‘দাদা, আপনারা তো এখন সব জায়গায় ঘুরছেন। কী বুঝছেন, মাস্টার প্ল্যান কার টাকায় হবে বলুন তো? মোদী না মমতার।”
ঘাটালে এ বারও ভোটে তুরুপের তাস ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান।’ সেই ১৯৫৯ সাল থেকে মানসিংহের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকল্পের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এর পরেও এই প্রকল্প নিয়ে এত টানাহ্যাঁচড়া দেখে হতবাক ঘাটালবাসীও। এক সময় অবশ্য এই প্রকল্প বাস্তবায়ের পথে অনেকটাই এগিয়েছিল। সেটা ছিল ১৯৮২ সাল। প্রকল্পের সলতে পাকিয়েছিল বামেরাই। বাম আমলেই টাকা বরাদ্দের পর ঘটা করে প্রকল্পের উদ্বোধনও হয়েছিল। তবে মাঝপথে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তার এত বছর পরে এখনও প্রাসঙ্গিক ওই প্রকল্প। ফের অবশ্য নতুন করে প্রকল্প নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়। নতুন করে ডিপিআর তৈরি হয়। এই মুহুর্তে ১৭৪০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পের টাকা বরাদ্দ নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের টালবাহানায় আটকে গোটা প্রকল্প। ঘাটালের ওই প্রকল্পই এখন প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার।
সম্প্রতি ভোটের মুখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, ওই প্রকল্প রাজ্য সরকার একাই কার্যকর করবে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরই লোকসভা ভোটের প্রচারের কেন্দ্রে থাকছে এই মাস্টার প্ল্যান। শাসক দল বিভিন্ন সভা, রোড শোয়ে মাস্টার প্ল্যানকে প্রচারে টেনে আনছে। এই পরিস্থিতিতে পিছিয়ে নেই পদ্ম শিবিরও। মাস্টার প্ল্যানের সুফল পেতে তেড়েফুঁড়ে নেমেছে তারাও।ভোটে জিতলেই মোদীর টাকাতেই মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন হবে, প্রচার করছে বিজেপি। এরপরই ঘাটাল জুড়ে যে আলোচনা ঝড় তুলেছে, তা হল মাস্টার প্ল্যান কার টাকায়? মোদীর না মমতার। তর্কের গতি বেড়েছে সম্প্রতি পিংলায় মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া শর্ত নিয়ে। ঘাটাল,মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম লোকসভা আসন জিতলেই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান হবে, মুখ্যমন্ত্রীর ওই কথায় প্রাথমিক ভাবে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। পরে অবশ্য তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ফের একবার জানিয়ে দেন, মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করবে রাজ্য সরকারই।
ঘাটাল জুড়ে সমস্যা অনেক। পরিকাঠামো উন্নয়ন থেকে সাজানো গোছানো শহর বলতে যা বোঝায়, তার থেকে এখনও অনেক দূরে ঘাটাল। ভোটের সময় রাজনৈতিক দলগুলি শহরের উন্নয়ন নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। ফলে বয়স বড়লেও শ্রী ফেরে না মহকুমার এই সদর ব্লক ও শহরের। তবে প্রতি ভোটে (সে বিধানসভায় হোক,কিম্বা লোকসভা) ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে ভোটের প্রচার সারে শাসক ও বিরোধী সবপক্ষ। এ বার তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের সঙ্গে এ বার জুড়েছে ঘাটালের রেলপথও। বছরখানেক আগে থেকেই ঘাটালে রেলপথ চালুর দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। তৈরি হয় কমিটিও। তারপর মাস্টার প্ল্যানের মতো ওই রেলপথও এ বার প্রচারে আলোয় এসেছে। বৃহস্পতিবার দাসপুরে পদ্ম প্রার্থীর প্রচারে এসে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মুখে ঘাটালে রেলপথ চালু নিয়ে আশার কথা শোনা গিয়েছে। তবে তার মধ্যে তৈরি হয়েছে সংশয়ও। বন্যা এলাকায় আবার রেলপথ কী? রেলপথ তৈরি হবে ভাল কথা। তার আগে তো মাস্টার প্ল্যান করে বন্যা মুক্ত করতে হবে।
গত বিধানসভা ভোটে ঘাটাল কেন্দ্রে বিজেপির কাছে হারতে হয়েছিল শাসক দলকে। ব্যবধান অবশ্য ছিল হাজার খানেক। পঞ্চায়েত ভোটে বিধানসভা ভোটের তিক্ততা ভুলে ঘাসফুলে অনেকে ফিরলেও পদ্ম কাঁটায় এখনও বিদ্ধ শাসক তৃণমূল। ঘাটালের উত্তর এলাকার একাংশে পদ্মের দাপটে অনেকটা দিশেহারা অবস্থা শাসক তৃণমূলের। যদিও গত(২০১৯)লোকসভা ভোটের নিরিখে ঘাটাল বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ছিল ৭১৭৯৫৯টি ভোট। পদ্ম প্রার্থী পেয়েছিলেন ৬০৯৯৮৬। বাম প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ছিল ৯৭০৬০। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে ঘাটালে বিজেপি প্রার্থী পেয়েছিলেন ১০৫৮১২। তৃণমূল পেয়েছিল ১০৪৮৪৬ ভোট। সিপিএম পেয়েছিল ১০১৬৫টি ভোট। পুরসভা ভোটে অবশ্য ঘাটাল বিধানসভার দুটি পুরসভা তৃণমূলের দখলে রেখেছিল। পঞ্চায়েত ভোটেও এগিয়ে তৃণমূল। তবে ঘাটাল ব্লকের তিনটি পঞ্চায়েত দখল করে বিজেপি। বামেরা কোনও আসন না পেলেও ভাল ভোট পেয়েছিল তারা।
মাস্টার প্ল্যান প্রকল্প নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ওই ‘মাস্টার স্ট্রোক’কে হাতিয়ার করে বিধানসভার ফলাফলকে পেছনে ফেলে গত লোকসভার ব্যবধান ফিরিয়ে আনতে মরিয়া শাসক শিবির। তৃণমূলের ঘাটাল সাংগঠনিক জেলা সভাপতি আশিস হুতাইত বলেন, “মাস্টার প্ল্যান কার্যকর হলে ঘাটাল দুর্ভোগ থেকে বাঁচবে। এটাই চেয়েছিলেন ঘাটালের বাসিন্দারা। সেই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের চ্যাম্পিয়ান দেব। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সে কথা ঘোষণা করেছেন। ঘাটালের মানুষও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই রয়েছেন।” বিজেপি বিধায়ক শীতল কপাটের অবশ্য দাবি, ‘‘তৃণমূল বাস্তবের মাটিতে নেই। মানুষ যে আর তাদের সঙ্গে নেই,সেটা তারা বুঝতে পারছে না। তাই স্বপ্ন দেখছে।” সিপিএমের নিশানায় অবশ্য তৃণমূল বিজেপি দুই দলই। সিপিএম নেতা অশোক সাঁতরা বলেন, “ঘাটালে তৃণমূল বিজেপির সেটিং চলছে। দুর্নীতি নিয়ে মানুষের মন ঘোরাতে মিথ্যা খেলায় মেতেছে তারা। মূল্যবৃদ্ধি,দুর্নীতির কথা মানুষ ভুলে যায়নি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy