Advertisement
E-Paper

বাবা বাম, ছেলে বিজেপি, নাতি তৃণমূল! বাংলায় কি অবলুপ্ত ‘আমাদের বাড়ি’ শব্দ, ছিঁড়ছে বাড়ির টান!

একান্নবর্তী পরিবার এখন বিরল। আগে হাঁড়ি আলাদা হলেও বাড়ি এক ছিল। সেই বাড়িতে যদি ২০-২৫ জন ভোটার থাকতেন, তা হলে সবার রাজনৈতিক পছন্দে একটা অভিন্নতা থাকত। এখন তা খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

Is the formation of political opinions in the family tradition going to end in Bengal politics

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৫৭
Share
Save

চিত্র ১: ৭২ ছুঁই-ছুঁই অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষকের নাম অসীম চাকলাদার। বাস হুগলি জেলার এক প্রাচীন শহরে। একটা সময়ে সক্রিয় ভাবে সিপিএম করতেন। এখন বয়সের কারণে পারেন না। তবে মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়ের আহূত ব্রিগেড সমাবেশে পাড়ার ‘কমরেড’দের সঙ্গে বাসে করে পৌঁছেছিলেন। তাঁর দাবি, ‘‘আমার রক্তে সিপিএম।’’

কিন্তু সেই অসীমই জানালেন, তাঁর ছেলে খানিকটা ‘বিজেপি ঘেঁষা’ হয়ে গিয়েছেন। সেই ছেলের বয়স ৪৭ বছর। কর্মরত ক্যানিং স্ট্রিটের এক বেসরকারি সংস্থায়। সেই সংস্থা চিন থেকে খেলনা এনে কলকাতা-সহ আশপাশের এলাকায় সরবরাহ করে। সেই সংস্থার মালিক রাজ্য বিজেপির এক নেতার ‘ঘনিষ্ঠ’। সেই পরিসরে থাকতে থাকতে অসীমের ছেলেরও নরেন্দ্র মোদীকে বেশ মনে ধরেছে। আবার অসীমই জানিয়েছেন, তাঁর নাতি গ্র্যাজুয়েশন পড়তে পড়তেই কাজ পেয়েছেন সিভিক ভলান্টিয়ারের। নাতি ভলিবল খেলেন হুগলির ভদ্রেশ্বরের একটি ক্লাবে। লম্বা-চওড়া চেহারা। ২১ বছর বয়সি নাতি দাদুকে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ‘দিদিভক্ত’। অসীমের স্ত্রী সিপিএম। কিন্তু বৌমা মনে করেন, দিদির ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ ভাল। তবে দেশে দরকার মোদীকেই।

কিন্তু আগে এমন ছিল না। আগে অসীমের বাড়ির সব ভোট ছিল বামেই।

চিত্র ২: দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ নুঙ্গির ‘চৌধুরীবাড়ি’র কর্তা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ক কর্মচারী গৌতম চৌধুরী। তিনি বামপন্থী। তাঁর স্ত্রী উলুবেড়িয়ার খানদানি কংগ্রেস বাড়ির মেয়ে। তিনি এখনও ‘হাত’ কংগ্রেস। পছন্দ করেন না তৃণমূলকে। গৌতমের ছেলে চাকরি করেন বেসরকারি সংস্থায়। তিনিও বাবার মতোই বামঘেঁষা। বৌমার সে অর্থে রাজনৈতিক মতামত নেই। আবার নাতনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভক্ত। কারণ? বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের পড়ুয়া সেই নাতনি দাদুকে জানিয়েছেন, কন্যাশ্রী, স্মার্ট ফোন তাঁকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। তবে পাশাপাশিই তিনি দাদুকে এ-ও জানিয়েছেন যে, তিনি ‘দুর্নীতি’কে সমর্থন করেন না।

আগে ভোট এলেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ‘আমাদের বাড়ি’ ধরে ধরে ভোটের অঙ্ক কষতে। পাড়া, রাস্তা, এলাকা ধরে হিসাব হত, অমুক বাড়ির সবক’টা ভোট একধারসে কোন প্রতীকে পড়বে। সেই থেকে মোটামুটি ভ্রান্তিহীন একটা আন্দাজও পাওয়া যেত জয়-পরাজয়ের। সেই দিন এখন আর নেই। যে সূত্রে এমন একটা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে, এক পরিবারে অনেক মত, এমন বাড়ির সংখ্যা কি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলার রাজনীতিতে? কালে কালে কি বিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে শহর, শহরতলি, মফস্‌সল এমনকি, গ্রামের রাজনীতিতেও বহুলপরিচিত লব্জ ‘আমাদের বাড়ি’? তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস —সব দলের নেতারা একবাক্যে মানছেন, ‘আমাদের বাড়ি’ ক্রমে কমে আসছে।

কেন? তার ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন তাঁরা।

কারণ, একান্নবর্তী পরিবার এখন কার্যত বিরল। আগে হাঁড়ি আলাদা হলেও বাড়ি এক ছিল। সেই বাড়িতে ২০-২৫ জন ভোটার থাকলে মোটামুটি সকলের রাজনৈতিক পছন্দে একটা ‘অভিন্নতা’ থাকত। যে কারণে পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক দলগুলির কর্মীরা বলতেন, ‘ওটা আমাদের বাড়ি’ বা ‘ওটা পুরো ওদের (বিরোধী দলের) বাড়ি’। কিন্তু এখন সে সব নেই। এক বাড়িতে অনেক ভোট রয়েছে, এমন বাড়ি তো বটেই, চার বা ছ’জনের পরিবারেও রাজনৈতিক মতের ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। ফলে স্থানীয় স্তরে কোনও দলই আর হলফ করে বলতে পারছে না ‘ওটা আমাদের বাড়ি’।

কেন? রাজনীতির কারবারিরা কী বলেন?

তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘বহুতল সংস্কৃতিতে বাড়ি বিষয়টাই ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া বাড়ির মধ্যেও বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতামত লক্ষ করা যাচ্ছে। এ কথা ঠিক যে, এখন সে ভাবে ‘আমাদের বাড়ি’ বলে কোনও দলই কিছু বলতে পারছে না।’’ তবে পাশাপাশিই কুণালের বক্তব্য, একই পরিবারে রাজনৈতিক মতের ভিন্নতা গণতন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষণ। তাঁর কথায়, ‘‘এটা দলগুলির জন্য ভাল, যে তাঁদের চ্যালেঞ্জের মধ্যে কাজ করতে হবে।’’

সিপিএম নেতা তথা দমদম লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীও বলছেন, ‘‘এখন একান্নবর্তী পরিবার বিষয়টাই চলে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ছোট ছোট পরিবার। এর নেপথ্যে অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। একই পরিবারে ভিন্ন রাজনৈতিক মত তৈরি হওয়া তারই ফল।’’ তবে সুজনের বক্তব্য, ‘‘আমি মনে করি, একই পরিবারে বিবিধ মত থাকা কোনও নেতিবাচক বিষয় নয়।’’

রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ীর বক্তব্য, ‘‘আগে আমাদের বাড়ির ধারণাটা ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে। কিন্তু এখন সেটা ভেঙে গিয়েছে। কারণ, সমাজমাধ্যমে নিজের অভিমত প্রকাশের বা বিরোধিতা করার যে পরিসর তৈরি হয়েছে তা রাজনৈতিক ভাবে অনেককেই পরিণত করছে। সেই কারণেই এটা হচ্ছে।’’ রাজর্ষির মতে, এটি ‘ইতিবাচক’।

প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র সুমন রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘আগে যে ভাবে বামেরা বা কংগ্রেসিরা ‘আমাদের বাড়ি’ বলত, তা বলা যাচ্ছে না। যে কারণে আমাদের যে ভোটব্যাঙ্ক, তাতে ধস নেমেছে। তার কারণ হিসেবে আমি মনে করি, মতাদর্শের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থের বিষয়টি এখন রাজনীতিতে মুখ্য হয়ে উঠেছে।’’ সুমনও স্বীকার করেছেন, ছবি আমূল বদলে গিয়েছে।

তবে ‘আমাদের বাড়ি’ কি আর একেবারেই নেই? আছে। তবে নগণ্য। সোদপুরের ঘোলা এলাকার একটি পরিবার রয়েছে। যে বাড়িতে ১৭ জন ভোটার। পরিবারের দু’জন রাজ্য পুলিশে চাকরি করেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সেই বাড়ির বড় ভাই বলেছেন, ‘‘আমাদের বাড়ির সকলেই সিপিএম।’’ যদিও কথায় কথায় এই সংশয় গোপন করেননি যে, তিনি জানেন না কত দিন ওই ‘ঐক্য’ থাকবে। বিভিন্ন দলের গ্রাম-শহরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এখন পরিবারের মহিলারাও নিজেদের রাজনৈতিক মতামত জোরের সঙ্গে প্রকাশ করছেন। কখনও কখনও তাঁরা স্বামীর মতামতের বিরুদ্ধেও চলে যাচ্ছেন। হুগলির হরিপালে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে দলের তরফে কাজ করতে গিয়েছিলেন এক তরুণ সিপিএম নেতা। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘এমনও বাড়িতে গিয়েছি, যেখানে বাগদি পরিবারের স্বামী বলছেন, আমরা তো তৃণমূলকে হারাতে চাই। কিন্তু আমাদের বাড়ির মহিলারাই তো ওই মহিলাকে (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ভোট দিয়ে জিতিয়ে দিচ্ছে!’’

তবে এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক মতপ্রকাশে মহিলাদের ‘ক্ষমতায়ন’ হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক মহলের অনেকে। এবং প্রায় সকলেই মানছেন, পারিবারিক পরম্পরায় রাজনৈতিক মতামত তৈরি হওয়ার প্রবণতা ক্রমশ শেষের পথে। ‘নাড়ির টান’-এর মতোই ছিঁড়ে যাচ্ছে ‘বাড়ির টান’। পুরোপুরি উবে যাওয়া আপাতত কয়েকটি ভোটের অপেক্ষা!

Lok Sabha Election 2024 West Bengal Politics

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।