আলোয় ঝলমলে কাশী বিশ্বনাথ করিডর। — নিজস্ব চিত্র।
‘সেই শিবলিঙ্গ কোথায়?’ কাশী বিশ্বনাথ মন্দির চত্বরের মধ্যেই খোঁজাখুঁজি শুরু করেছিলেন গুজরাতি পরিবারের মহিলারা। এক নিরাপত্তাকর্মী জ্ঞানবাপী মসজিদের দিকে ফটক দেখিয়ে দিলেন। নন্দী মূর্তির পাশের ফটক পার হলেই মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের তৈরি জ্ঞানবাপী মসজিদ। চারদিকে লোহার বেড়াজাল। তার উপরে কাঁটাতার।
মন্দির চত্বরের প্রাচীর ও মসজিদের লোহার বেড়াজালের মাঝখান দিয়ে কয়েক পা এগোলেই মসজিদের গায়ে একটা ছোট্ট ঘরের মুখে পুরোহিত বসে। ভিতরে কিছু দেবদেবীর মূর্তি। নিয়মিত পুজোআচ্চা হয়। এই সেই জ্ঞানবাপী মসজিদের তেহখানা। স্থানীয় মানুষদের মুখে ‘ব্যাসজি কা তেহখানা’। বারাণসীর শৈলেন্দ্র পাঠক ব্যাসের দাবি ছিল, তাঁর পূর্বপুরুষরা মসজিদের তেহখানায় বছরের পর বছর পুজোআচ্চা করে এসেছেন। বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে উত্তরপ্রদেশের মুলায়ম সিংহ যাদবের সরকার তা বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন আদালতের নির্দেশে আবার পুজো শুরু হয়েছে।
কাশী বিশ্বনাথ মন্দির থেকে বেরিয়ে অনেকেই তেহখানায় এসে প্রণাম করে যাচ্ছেন। আর প্রশ্ন করছেন, ‘‘মসজিদের মধ্যে আবিষ্কার হওয়া সেই শিবলিঙ্গ কোথায়?” পুরোহিত বললেন, ‘‘সে তো মসজিদের ভিতরে, ওজুখানায়। ওখানে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। এখান থেকে দেখা যায় না।’’
অযোধ্যায় রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিবাদের ফয়সালা হয়েছে। তার পরে মথুরার শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি-শাহি ইদগা এবং কাশীর আদি বিশ্বেশ্বর মন্দির-জ্ঞানবাপী মসজিদ বিবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। বারাণসীর আদালতে দাবি উঠেছে, জ্ঞানবাপী মসজিদ সরিয়ে স্বয়ম্ভু আদি বিশ্বেশ্বর মন্দির ফেরাতে হবে।
‘‘এই মন্দির-মসজিদ বিবাদ হল রাজনীতিকদের তৈরি করা। এ সব করে কি আর আমজনতার ভাগ্য বদলায়?”—বলছিলেন বিরক্ত অমিত শেঠ। নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে বারাণসীতে গঙ্গার ঘাট থেকে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে যাওয়ার রাস্তায় পুরনো বাড়ি, ছোটখাটো মন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছে চওড়া করিডর। অমিত শেঠের জমি-বাড়িও ঢুকে গিয়েছে। ভাল ক্ষতিপূরণ মিললেও মন্দির-মসজিদ বিবাদে বিরক্ত অমিত বলেন, ‘‘এগুলো ভোটের স্বার্থে বিভাজনের খেলা।’’
এ বারের ভোটে বিজেপি কাশী-মথুরায় মন্দিরের দাবিকে রাজনীতির হাতিয়ার করেনি। তবে ভোটের আগে আদালতে দাবি উঠেছে, যেখানে ঔরঙ্গজেবের জ্ঞানবাপী, সেখানেই সত্যযুগ থেকে আদি বিশ্বেশ্বরের মন্দির ছিল। আদালতের নির্দেশে পুরাতত্ত্ব বিভাগ সমীক্ষা করে বলেছে, মসজিদের নীচে মন্দির রয়েছে। বারাণসীর পাঁচ জন মহিলা আবার মসজিদের মধ্যে শৃঙ্গার গৌরী, গণেশ, হনুমানের মূর্তিতে পুজো করতে চেয়ে আদালতে গিয়েছেন। তাঁদের আর্জিতে সায় দিয়ে বারাণসীর আদালত কমিশনারকে সমীক্ষা করতে বলেছিল। সমীক্ষা রিপোর্ট বলেছে, ওজুখানায় শিবলিঙ্গের মতো বস্তু মিলেছে। তেহখানার সামনে এসে সবাই সেই শিবলিঙ্গ দেখতে চাইছেন। মসজিদের দায়িত্বপ্রাপ্ত অঞ্জুমান ইন্তেজামিয়া মসজিদের দাবি, ওটা ফোয়ারা। শিবলিঙ্গ নয়।
শিবলিঙ্গ না ফোয়ারা? কে এর ফয়সালা করবে? ভোরবেলা রোজ দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে মুন্সিঘাটে গঙ্গাস্নান করেন সঙ্কটমোচনের মন্দিরের এক পুরোহিত। সিঁড়ির সামনেই ঘাটের কুঠুরিতে ছোট-বড় তিন-চারটি শিবলিঙ্গ। তাতে জল ঢালতে ঢালতে পুরোহিত বললেন, ‘‘যদি নাম না লেখেন, তা হলে একটা কথা বলতে পারি। এই বারাণসীর প্রতিটি পাথরেই শিব রয়েছেন বলে মানুষের বিশ্বাস। তাই যে কোনও পাথরকেই যে কেউ শিবলিঙ্গ ভেবে পুজো করতে পারেন! আর বারাণসীতে শতকের পর শতক হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান।’’
আপাতত সুপ্রিম কোর্টে সেই সহাবস্থানই চলছে। জ্ঞানবাপীতে নমাজ, তেহখানায় পুজো—দুই-ই হচ্ছে। ভোটের পরে আবার জুলাই মাসে শুনানি। নির্বাচনের মরসুমে অঞ্জুমান ইন্তেজামিয়ার কেউ এ নিয়ে আর প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি নন। তবে চার দেওয়ালের মধ্যে মসজিদ কমিটির এক কর্তা দুশ্চিন্তার কথা শোনালেন। ‘‘আজ তেহখানায় পুজোর দাবি উঠেছে। এরপরে ওজুখানায় পুজোর দাবি উঠবে। ভবিষ্যতে বাবরি মসজিদের মতো হয়তো জ্ঞানবাপীও সরানোর দাবিতে আন্দোলন হবে! আমাদের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে এটাই বলেছেন।’’
বাবরি মসজিদ ভাঙার পরেই বিজেপি-আরএসএস স্লোগান তুলেছিল, ‘অযোধ্যা তো ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা অভি বাকি হ্যায়!’ মসজিদ কমিটির এক আইনজীবী বলছেন, ‘‘এখন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর মিছিল থেকে স্লোগান ওঠে— তিন নহি, তিস হাজার, অব না রহেগি কোই মসজিদ ইয়া মাজার! এই যে সব মামলা হচ্ছে, এর পিছনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বিভিন্ন সংগঠন। অযোধ্যার মামলাতেও এরাও ছিল।’’
বারাণসীর জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ মুসলিম। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, হাজার বছরের প্রাচীন বারাণসীতে প্রায় তেত্রিশশো হিন্দু মন্দির রয়েছে। আবার তেরোশো মসজিদ-মাজার-দরগাও রয়েছে। এর মধ্যে গাজি মিয়াঁ, মকদুম শাহের মতো অনেক দরগা-মাজারের উৎসব বা মেলায় হিন্দুরাও ভিড় জমান। আবার বারাণসীর মদনপুরা, রেওড়ি তালাওয়ের মুসলিমরা রামলীলা দেখতে ভিড় করেন। জ্ঞানবাপী নিয়ে আদালতের শুনানিতে তাঁদের জীবনে কোনও রদবদল হয় না।
গোধূলিয়ার মোড় (গদৌলিয়া চওক) থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে পিলি কোঠির অলিগলিতে বেনারসী শাড়ির আঁতুড়ঘর। দেবেন্দ্র পাঠক শাড়ি বেচেন। তাঁত চালান রিজওয়ান। মন্দির-মসজিদ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। রিজওয়ান বলেন, ‘‘আগে কখনও সখনও জ্ঞানবাপীতে যেতাম। এখন বড্ড পুলিশের কড়াকড়ি। শরীরের তল্লাশি। উটকো ঝামেলায় কে যাবে!’’
জ্ঞানবাপী মসজিদ হাতছাড়া হলে কী করবেন? মদনপুরে থেকে রোজ গোধূলিয়া মোড়ের হোটেলে সাফাইয়ের কাজ করতে আসেন রেশমা বিবি। ছেলে মকবুল আগে বেনারসি শাড়ি বোনার কাজ করত। রোজগার মন্দ বলে মকবুলও হোটেলের কাজ ধরেছে। রেশমার উত্তর, ‘‘মসজিদ নয়, ছেলের ভবিষ্যৎটা আসল। তার জন্য কে কী করছে বলুন তো?”
বিশ্বনাথ দর্শনের অপেক্ষায় ভক্তরা জয়ধ্বনি দেন—‘হর হর মহাদেব’। মদনপুরার মসজিদে আজানের ডাক ভেসে আসে। নির্বাচন কমিশনের প্রচার-গাড়ি থেকে আহ্বান শোনা যায়, ‘সবাই দলে দলে ভোট দিন। গণতন্ত্রের উৎসবে যোগ দিন।’ (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy