গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
দলের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তৃণমূলের ১৩ জন পরাজিত প্রার্থীর অন্যতম দেবাংশু ভট্টাচার্যকে। সূত্রের খবর, দেরি করে প্রচারে বেরোনো নিয়েই শনিবার নেত্রীর ক্ষোভের মুখে পড়েন দেবাংশু। আর রবিবারই নিজের ফেসবুক পেজে দলনেত্রীর সেই বক্তব্যকে কার্যত চ্যালেঞ্জ করে নিজের ‘পাগলের মতো’ কাজ করার খতিয়ান দিলেন তমলুকের পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী। যা দেখে দলের অন্দরে অনেকেই বিস্মিত এবং বিরক্তও। তৃণমূলের মুখপাত্র শান্তনু সেন এই পোস্ট দেখার পর নিজের বিরক্তি গোপন রাখেননি। তাঁর মতে, নিজের ভাল চাইলে তরুণ দেবাংশু নেত্রীর কথা অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন।
শনিবারের বৈঠকে তৃণমূলনেত্রী বলেছিলেন, দেবাংশুর বয়সে তিনি সকাল ৭টা থেকে রাস্তায় থাকতেন। বেলা ১২টার সময় বেরোতেন না। তৃণমূল সূত্রের খবর, দলের কাছে তমলুক থেকে এই মর্মে অভিযোগও এসেছিল যে, দেবাংশুকে সকাল সকাল প্রচারে পাওয়া যেত না। শনিবার তা নিয়েই তরুণ নেতাকে ‘ভর্ৎসনা’ করেছিলেন মমতা। কিন্তু রবিবার দুপুরে ফেসবুক পোস্টে দেবাংশু লিখেছেন, ‘‘সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে টয়লেট সেরে, স্নান করে, এক বাটি ছাতুর শরবত খেয়ে রোজ বেরিয়ে পড়তাম সকাল ৮–টার মধ্যে।’’ অর্থাৎ দেবাংশুর কথায়, তিনি যথাবিধি পরিশ্রম করেছেন এবং যথাসময়ে প্রচারেও বেরিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের এক নেতার কথায়, ‘‘আমি দলের মুখপাত্র নই। তাই কোনও বিবৃতি দিতে পারব না। কিন্তু দেবাংশু যা লিখেছে, তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে।’’
দেবাংশু ওইটুকুতেই থামেননি। নিজের পরিশ্রমের ‘প্রমাণ’ হিসাবে তিনি লিখেছেন, ‘‘মার্চে ওজন ছিল ৮৩ কিলো। যা আজ কমে ৭৭.. সৌজন্যে শেষ আড়াই মাস। এই ৬ কিলো ওজনের বিনিময়ে ৬ লক্ষ ৮৭ হাজার মানুষের ভালবাসা পেয়েছি, আশীর্বাদ পেয়েছি। সেটাই আমার কাছে এই নির্বাচনের নির্যাস...।।’’
নিজের হারের পিছনে দু’টি কারণ তুলে ধরেছেন দেবাংশু। তার একটি হল ‘টাকার কাছে হার’! দেবাংশু লিখেছেন, ‘‘পরিশ্রমে নিজের ১০১% দিয়েছি। যা করতে পারি তার বেশি করেছি।... নিজেদের সবটা দেওয়ার পরেও অর্থের কাছে হেরে গিয়েছি। এত কোটি কোটি টাকার বিরুদ্ধে আমাদের স্বল্প ক্ষমতার লড়াই ব্যর্থ হয়েছে। গোটা জেলায় নেতা-কর্মী নয়, ভোট করিয়েছে কেবল টাকা।’’
দ্বিতীয় কারণ হিসাবে তিনি আঙুল তুলেছেন নন্দীগ্রাম বা ময়নার মতো জায়গায় তৃণমূলের সাংগঠনিক দুর্বলতার দিকে। লিখেছেন, ‘‘নন্দীগ্রাম-ময়নার বাকচা অঞ্চলে তৃণমূল নাম উচ্চারিত হলে মারধর, এমনকি প্রাণহানিও সেখানে নতুন নয়। দলের ঝান্ডা বাঁধার লোক অবধি সেখানে নেই। সেই পরিস্থিতে সবটা এতটা একপেশে হয়ে গিয়েছিল, এক সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল এই নির্বাচন এখন লড়া, না লড়া সমান ব্যাপার। তবুও আমরা হাল ছাড়িনি! পরিস্থিতির সুযোগে আমার বিপরীতের প্রার্থী আধা বেলা প্রচার না করেও জিতে গিয়েছেন... আর আমি পাগলের মতো বুথ বুথ ঘুরেও জিততে পারিনি।’’
রবিবার তরুণ নেতার ওই ফেসবুক পোস্ট প্রকাশ্যে আসতেই তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায় তৃণমূলের অভ্যন্তরে। তৃণমূলনেত্রীর ঘনিষ্ঠেরা জানেন, তিনি দলীয় বৈঠকে বহু নেতাকেই বহু বার তিরষ্কার করেছেন। সেই ভর্ৎসনা থেকে বাদ যাননি তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রও। আবার বিপদে সেই মহুয়ারই পাশে দাঁড়িয়েছেন নেত্রী মমতা। সংসদ থেকে যখন তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তখন মমতা বলেছেন, ‘‘ওকে বার করে কী হবে, ও তো আবার জিতে পরের বার সংসদেই আসবে।’’ অর্থাৎ রাজনীতিতে তিনি যেমন দিদি বলে পরিচিত, তেমনই দলের অন্দরেও বড় দিদির মতোই বকাবকি করে থাকেন নেতাদের। কাজ পছন্দ না হলে তিরস্কার করেন। কিন্তু তাঁদের কখনও নেত্রীর বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলতে শোনা যায়নি। কারণ তাঁরা সবাই বিশ্বাস করেন, মমতা যা বলেন, তা আসলে ভালর জন্যই বলেন। রবিবার যেমনটা বলেছেন, তৃণমূলের মুখপাত্র শান্তনুও। তিনি বলেন, ‘‘দলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই শেষ কথা, তাঁর বলা কথাকে কনট্রাডিক্ট না করে শিরোধার্য করা উচিত। তিনি যা বলেন, আমাদের ভালর জন্য, দলের ভালর জন্য।’’
সাধারণ দলীয় শৃঙ্খলা বলে, দলের অভ্যন্তরীণ বৈঠকে বলা কথা দলের ভিতরেই আলোচিত হবে। তা নিয়ে নেতাদের বক্তব্য থাকতেই পারে, তবে তা নিয়ে বাইরে আলোচনা করা দলীয় শৃঙ্খলবিরোধী। যে কোনও দলের নেতা- কর্মীকেই এই নিয়ম মানতে হয়। সেখানে দেবাংশু শুধুই একজন নেতা নন। তাঁকে এই লোকসভা ভোটে রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। খাস শুভেন্দু অধিকারীর তালুক পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছিলেন দেবাংশু। ব্রিগেডে তাঁর নাম ঘোষণা করার সময় তাঁকে ‘ভ্রাতৃসম’ আখ্যা দিয়েছিলেন অভিষেক। দেবাংশুর হয়ে প্রচারে গিয়েও তাঁর প্রশংসা করেছেন মমতা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দেবাংশু জিততে পারেননি। বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ৭৭ হাজার ৭৩৩ ভোটে হেরেছেন।
তবে সেই ব্যর্থতার জন্য তিরস্কার তিনি সহজ ভাবে নিতে পারেননি। বরং এক ধাপ এগিয়ে দলের সর্বময় নেত্রীর বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে নিজের মতামত তুলে ধরেছেন। যা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছেন তৃণমূলের বহু প্রবীণ নেতাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy