আশীর্বাদ নিচ্ছেন লুরিনজ্যোতি গগৈ। —নিজস্ব চিত্র।
প্রথম বারের দেখা হওয়াটা ছিল নিছকই কাকতালীয়। কিন্তু এ বার ভূপেন হাজরিকার ভাষায়, একেখন নাওয়েরে যাত্রী থাকা এক নেতার বাড়িতে অন্য নেতার উপস্থিতি রীতিমতো পরিকল্পনামাফিক ও রাজনৈতিক। যদিও আগাগোড়া তা মোড়া ছিল সৌজন্যের মলাটে।
রাজনৈতিক প্রার্থীরা ঘরে ঘরে ভোট চাইতে যাবেনই। কিন্তু সচরাচর নিজের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর বাড়ি বা তাঁদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ভোট চাওয়ার বাহুল্য তাঁরা বর্জনই করেন। কিন্তু উল্টোটাই করলেন উজানি অসমে ডিব্রুগড় লোকসভা কেন্দ্রের ইন্ডিয়া ব্লক প্রার্থী, অসম জাতীয় পরিষদের সভাপতি লুরিনজ্যোতি গগৈ। শনিবারের সকাল সকাল তাঁর প্রথম গন্তব্যই ছিল মুলুক গাঁও। যা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও লুরিণের বিরুদ্ধে লড়তে নামা বিজেপি প্রার্থী সর্বাসন্দ সোনোয়ালের বাড়ি।
তাঁরা শুধু এক নৌকার যাত্রীই ছিলেন না, লুরিণের কথায়, “আমরা এক মায়ের সন্তান বলতে পারেন। কারণ, দুইজনই ছাত্র আন্দোলনের ফসল।” সর্বানন্দ আসুর প্রাক্তন সভাপতি। লুরিণ প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক। সর্বানন্দ অতীতে আসু ভেঙে তৈরি হওয়া অসম গণ পরিষদ থেকে ডিব্রুগড়ের সাংসদ হয়েছিলেন। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে তিনি লখিমপুর থেকে লড়ে জিতলেও, নিজের জন্মভূমি ডিব্রুগড়ে প্রথমবার বিজেপি প্রার্থী হিসেবে লড়তে নামছেন। এ দিকে লুরিণ আসু থেকে বেরিয়ে অসম জাতীয় পরিষদ দল গঠন করে প্রথমবার বিধানসভা ভোটে একটাও আসনে জিততে পারেননি। তাও কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিরোধী ঐক্য মঞ্চ সোনোয়ালের বিরুদ্ধে তাঁর উপরেই বাজি ধরেছে।
কাকতালীয়ভাবে ডিব্রুগড়ে প্রচার শুরুর প্রথম দিন হালদিবাড়ি নামঘর থানে পুজো দিয়েই প্রচারের সূচনা করার পরিকল্পনা করেন দুজনই। এমনকী একই সময়ে দুই জন হাজির হন মন্দিরে। পাশাপাশি বসা দুই তাবড় প্রার্থীর ছবি ভাইরাল হয়। প্রশংসিতও হয়। কারণ, দুইজনই সুভদ্র। প্রচারপর্বে তাঁরা কেউ কারও বিরুদ্ধে একটিবারও বিষোদ্গার করেনি।
কিন্তু যে সোনোয়াল অতীতে আইএমডিটি আইনের বিরুদ্ধে লড়াই করে আইন বাতিল করিয়েছেন, তিনিই বর্তমানে সিএএ আইনের সমর্থক- যার বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে ভূমিপুত্রদের মনে। এ দিকে আসুর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে লুরিণের নেতৃত্বে ২০১৯ সালে চলেছিল সিএএ বিরোধী আন্দোলন। তা থেকেই অসম জাতীয় পরিষদের জন্ম।
অঙ্কের এমএসসি লুরিণ এ দিন রাজনীতির অঙ্ক কষেই হয়ত হাজির হন সর্বানন্দের গ্রামের বাড়িতে। দুর্জনদের দাবি, মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে আদিবাড়ির সঙ্গে সর্বানন্দের ঘনিষ্ঠত কমেছে। লুরিণকে দেখে অপ্রস্তুত হলেও আন্তরিক স্বাগত জানান, সোনোয়ালের দাদা দীপক সোনোয়াল, তাঁর স্ত্রী ও প্রয়াত দাদা গিরীশ সোনোয়ালের স্ত্রী। চারিদিকে বিহুর মেজাজ। তাই ফুলাম গামোসা হাজির ছিলই। তড়িঘড়ি লুরিণকে গলায় গামোসা পরিয়ে অভ্যর্থনা জানান দীপক। সোনোয়াল পরিবারের সকলকে ফিরতি গামোসায় সম্মান জানান লুরিণও। বলেন, অসমের রাজনৈতিক জীবনে যে অবক্ষয় হচ্ছে, তা রুখে দিয়ে মূল্যবোধের রাজনীতি ফেরাতে হবে।
লুরিণের কথায়, “আমরা এক মায়ের সময় হলেও সময়ের বিড়ম্বনায় পথ আলাদা হয়েছে। আদর্শগত প্রশ্ন লড়াই তো করতেই হবে। কিন্তু লড়াই হবে ইতিবাচক। আমরা মূল্যবোধের রাজনীতি থেকে সরছি না। মতপার্থক্য থাকলেও সুস্থ গণতান্ত্রিক পথে তর্ক চলবে। সর্বাদার বাড়িতে আসু করার সময় অনেকবার এসেছি। এ বার তাঁর পরিবারের কাছে জয়ী হওয়ার, অসমের সঙ্কট মোচনের, মাটি ও অস্তিত্ব রক্ষা করার আশীর্বাদ চাইছি।”
দীপক বলেন, “প্রার্থীরা সকলের বাড়িতে আসবেনই। সকলের পরামর্শ ও আশীর্বাদও চাইবেন। লুরিণ আসায় খুব ভাল লেগেছে। আমরা তাঁকে সর্বান্তঃকরণে আশীর্বাদ করেছি।”
চিত্রনাট্যহীন নাটকের ক্লাইম্যাক্সে সর্বানন্দের বৌদি লুরিণের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘জয়যুক্ত হও’।
কিন্তু লুরিণের জয় মানে তো ঘরের ছেলের হার! এমন আশীর্বাদ ফলে গেলে কী হবে! দীপকের কথায়, “আমাদের হাতে ছিল আশীর্বাদের ভার। হারজিতের ভার তো জনতার হাতে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy