অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল ছবি।
প্যান্ট গুটিয়ে নিয়েছেন হাঁটুর কাছে। চপ্পল জোড়া খুলে রেখেছেন। মহেশতলার গলি থেকে গলি, পায়ের পাতায় জল ভেঙে এগোচ্ছিলেন ঠিকই, গতি বড় কম। ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের ভোটে এ এক খণ্ডচিত্র। আর তাকে এ বারের ভোট-যুদ্ধে এই কেন্দ্রের প্রতীক হিসেবে ধরা যেতে পারে।
কংগ্রেস সমর্থিত সিপিএমের প্রার্থী প্রতীক-উর রহমানের ওই গতির সঙ্গে তুলনীয় এই আসনে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিরোধীদের লড়াই। ভোটের সাজগোজে বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ (ববি) দাসকেও আলাদা দেখাচ্ছে না। অভিষেকের আভরণ, আয়োজন, আরোহণ একেবারে আলাদা।
ভোটের বাজারে রাজ্যের সব থেকে ‘হাই প্রোফাইল’ কেন্দ্রটিতে লড়াইয়ের তোপ, তেজ সম্ভবত সব থেকে কম। ‘হাই প্রোফাইল’ এই কারণে যে, বিদায়ী সাংসদ অভিষেকই এখানে তৃতীয় বার তৃণমূলের প্রার্থী। অঘটন ছাড়া এই কেন্দ্রে তাঁর পরীক্ষাই রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে সম্ভবত সহজতম! বিরোধীরা এক রকম অসম লড়াইয়েই রয়েছেন।
গত লোকসভা আর বিধানসভা ভোটের ফলও সেই রকমই। ডায়মন্ড হারবারে ২০১৯ সালে অভিষেক জিতেছিলেন তিন লক্ষ ২০ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে। সাতটি বিধানসভার মধ্যে মাত্র একটিতে তিনি এক লক্ষের কম ভোট পেয়েছিলেন। আর ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের হিসেবে এই লোকসভা আসনে তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান দু’লক্ষ ৮০ হাজারের মতো।
এই ব্যবধান মনে করিয়ে দিলে বিরোধীরা এক সুরে ‘রিগিং আর ছাপ্পা’র অভিযোগ করেন। গত লোকসভা নির্বাচনে কোনও কোনও বুথে ৮০, ৮৫, ৯০ বা ৯৯%-এরও বেশি ভোট পাওয়ার হিসেব রয়েছে কমিশনেরই। সেই তালিকা দেখিয়ে প্রতীক বললেন, ‘‘ডায়মন্ড হারবার, ফলতা, বিষ্ণুপুর, সাতগাছিয়া—গণতন্ত্রের চেহারাটা এই রকম! প্রশ্ন করলে পুলিশ আর তৃণমূল বাড়ি-ছাড়া করবে। এটাই তো ‘মডেল’! এই সিস্টেম ভেঙে যাবেই।’’ প্রতীক মানছেন, তৃণমূলকে ঠেকাতে বামেদের ভোট বিজেপি পেয়েছে। তবে ভাবছেন, ‘‘সেই ভুল ভাঙছে।’’ আবার এই কেন্দ্রে বিজেপির সাংগঠনিক আহ্বায়ক দেবাংশু পন্ডা বলছেন, ‘‘সিপিএমের ভোট গিয়েছিল তৃণমূলে। তা ফিরলে এ বার বিজেপির জয় নিশ্চিত।’’ সন্ত্রাসের অভিযোগ করে তাঁর সংযোজন, ‘‘আমাকেই মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে এলাকা-ছাড়া করার পরিকল্পনা করেছিল।’’
অসম লড়াইয়ের কথা শুনে গলার লাল কাপড়ের টুকরো কাঁধে ছুড়ে প্রতীক বললেন, ‘‘আমরা তো সাম্য প্রতিষ্ঠার কথাই বলি।’’ বয়সে অভিষেকের থেকে ছোট প্রতীক উদাহরণ হিসেবে টানলেন চার দশক আগের কথা। বললেন, ‘‘কে ভেবেছিলেন, চুরাশি সালে তরুণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হারিয়ে দেবেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে?’’ রাজনীতিতে ‘অঘটন’ হিসেবে মমতার সেই জয় উদাহরণই। কিন্তু সেই পরিস্থিতি বা আভাস এ বার এখানে অন্তত নেই।
এই কেন্দ্র থেকে ২০১৪ সালে প্রথম সাংসদ হয়েছিলেন অভিষেক। তবে কঠিন লড়াইয়ে পড়তে হয়নি তাঁকে। দলেরই সাংসদ প্রয়াত সোমেন মিত্রের কাছ থেকে তৃণমূলের নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় সেই ‘অভিষেক’ মসৃণই ছিল। তার পরে এই কেন্দ্রের ৭টি বিধানসভা কেন্দ্রে কাজ যে হয়েছে, অস্বীকার করার নয়। বজবজের তৃণমূল বিধায়ক অশোক দেবের সোজা হিসেব, ‘‘আমার কেন্দ্রে একটি পঞ্চায়েতের মাত্র একটি কাজ বাকি।’’ একই কথা ডায়মন্ড হারবারের বিধায়ক পান্নালাল হালদারেরও। বললেন, ‘‘একটা ‘সিস্টেম’ আছে। বেশি ভাবনা নেই।’’
প্রচারে অভিষেক বলেছেন, ‘১০ বছর সাংসদ হিসেবে তিনি সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার কাজ করেছেন।’ তা-ই ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’। বিরোধীদের মতো তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা আড়ালে বলেন, রাজ্য সরকারের বাড়তি গুরুত্ব পায় এই কেন্দ্রে। তার সুফল পান অভিষেক। তবে গোটাটাই মুঠোয় রাখে অভিষেকের ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থা। সম্ভবত একমাত্র এই কেন্দ্রেই বিধানসভা ভিত্তিক প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক রাখা আছে তৃণমূলের। সরকারি কাজ হোক বা দলের, শেষ কথা সেই ‘সিস্টেম’। ভোট নিয়ে নিশ্চিন্ত পান্নালাল বলেন, ‘‘পালতে ( পালন) হয় খুব!’’
বিধায়ক পান্নালালের দরজায় ‘তেপ্পল’ চাইতে এসেছিলেন ইয়ারজান বেওয়া। দু’দিনের ঝড়-জলে প্রৌঢ়ার ঘর গিয়েছে। বলেন, ‘‘আর বছর অভিষেককে (ফোনে সাংসদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা) ফোন করিচি।। হইনি। একটা ঘর দে, বাপ। না হয় একখানা তেপ্পল।’’ তৃণমূল জমানায় তৈরি ইলিশ গবেষণা কেন্দ্রও বন্ধ পড়ে। কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগও কিছু হয়নি ফলতার ‘বিশেষ অর্থৈনিতক অঞ্চলে’র প্রতিবেশী যুবক সুরজিৎ ঘোষের মতো স্নাতকের। তবে এখানে প্রথম বার্ধক্য ভাতা দিতে দলীয় স্তরে উদ্যোগী হয়েছিলেন সাংসদ। একশো দিনের বকেয়া টাকা মেটানোর দলীয় কর্মসূচিও এখানে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে পালিত হয়েছে।
ওই ‘সিস্টেম’ আর এই ‘লালন-পালন’ই মূল। তাই কার্যত ‘একপেশে’ এই লড়াইয়ে প্রচারে দাম্ভিক শোনালেও অভিষেকের জয়ের ব্যবধান বাড়ানোর আবেদনে এই মুহূর্তে ‘মেদ’ নেই। সিপিএমের প্রতীক অবশ্য তা মানতে নারাজ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রের প্রশ্ন, ‘‘ওই টাকা পেলেন কোথায়? সাংসদের পাঁচ বছরে ২৫ কোটি টাকা পাওয়ার কথা! নিজের কোম্পানির, না রাজ্য সরকারের? মানুষকে ধাপ্পা দিচ্ছেন।’’
কিন্তু সাড়ে তিন লক্ষের ব্যবধান এত সহজ হিসেবে মেলানো যে কঠিন, তাকে শক্তিশালী করেছেন বিরোধীরাই। নিষ্ঠা, সমন্বয় আর সংগঠনের অভাবে লড়াইয়ের বৃত্তে ঢুকতে পারেননি তারা। এই পর্বে আইএসএফ-বাম-কংগ্রেস জোট আর বিজেপির ফারাক নেই। আইএসএফের মুখ নওসাদ সিদ্দিকী প্রার্থী হবেন, হচ্ছেন করতে করতে সরে দাঁড়ানোয় তাঁর চ্যালেঞ্জ বাতাসে মিলিয়েছে। শেষমেশ সিপিএমের প্রার্থী হয়েছেন প্রতীক। যিনি আগে ডায়মন্ড হারবার বিধানসভা কেন্দ্রে লড়েছিলেন।
বিজেপি ২০১৪ সালে পরাজিত অভিজিতকে ফের প্রার্থী করেছে। ২০১৯ সালে বিজেপির প্রার্থী নীলাঞ্জন রায়ের পাওয়া ৩৪% ভোটের হিসেবই তাঁর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। অবশ্য এই কেন্দ্রের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা তাতে এগোয় না। শুধু এ বার ভোটে যে বিরোধী-বিন্যাস বদলের সম্ভাবনা, তা নিয়ে তরজা চলতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy