UK Election 2024

বিলেতের ভোটে বাংলায় বিজ্ঞপ্তি! কার বাংলা ভাল? লন্ডন না দিল্লি? নানা মুনির নানা মত, কিন্তু জিতল কে

কারও বক্তব্য, লন্ডনের বাংলা পাতেই দেওয়া যায় না। ভুলে ভরা। দিল্লির বাংলা নিয়েও ‘অভিযোগ’ রয়েছে বিস্তর। তবে মাতৃভাষায় লিফলেট পাওয়াকে ‘সম্মানজনক’ বলছেন ব্রিটেনে থাকা অনেক বাঙালি।

Advertisement
শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৪ ১৮:০৩
UK Election 2024: Postal Ballot Voting Rules Printed in Bengali

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বাম সরকারের আমলে এক মন্ত্রী ‘গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল’-এর বাংলায় নামকরণ করেছিলেন ‘মহান পূর্বীয় ভোজনালয়’। সে নাম যে চলেনি, তা বলাই বাহুল্য। পুলিশের পদস্থ অফিসারদের বাংলা হয়েছিল ‘আরক্ষাধ্যক্ষ’। সে বাংলাও কি চলেছে? সুধীজন বলতে পারবেন। না কি, মনে করতে পারবেন না?

Advertisement

এহ বাহ্য! তৃণমূল সরকারের আমলে ২০২২ সালে রাজ্যের আবগারি দফতরের অধীনস্থ একটি সংস্থার বিজ্ঞপ্তি ঘিরে বিস্তর টিকা-টিপ্পনি হয়েছিল। যেখানে ‘কান্ট্রি স্পিরিট’-এর বাংলা লেখা হয়েছিল ‘দেশীয় আত্মা’!

কোন বাংলা কুলীন, কোন বাংলা নয়, লেখার বাংলা আর বলার বাংলা এক হওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে তর্ক আবহমানকালের। কিন্তু কোন বাংলা ঠিক আর কোন বাংলা ভুল, তা নিয়ে খুব তর্ক-বিতর্কের অবকাশ নেই। সেই আবহেই এসে পড়েছে দিল্লির বাংলা আর বিলেতের বাংলার তুলনা। মোদীর বাংলা আর সুনকের বাংলার তুল্যমূল্য বিচার।

৪ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য ব্রিটেনের ভোটে যাঁরা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেবেন, তাঁদের কাছে পৌঁছেছে ভোট দেওয়ার ‘নিয়মাবলি’। বিভিন্ন ভাষায় তা ছাপিয়ে পাঠিয়েছে ভারপ্রাপ্ত রিটার্নিং অফিসারের দফতর। সেই তালিকায় রয়েছে বাংলাও। ইংল্যান্ডে বাংলাভাষী মানুষ নেহাত কম নেই। বহু বাঙালি সেখানকার নাগরিকও বটে। ফলে ভোটে বাংলাকে অগ্রাধিকার দিতেই হয়েছে সরকারকে। কিন্তু সেই বাংলা কতটা ‘বাংলা’, আর কতটা ‘বাংরেজি’ (ইংরেজি মিশ্রিত বাংলা), তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গেই তুলনা এসে পড়ছে ভারত সরকারের বাংলা নিয়েও। ভারতের মতো বহুভাষিক দেশে কেন্দ্রীয় সরকার অনেক নথিই বাংলায় ছাপে। দিল্লির ছাপা সে সব নথিতেও অনেক সময়ে ভুল বাংলা লেখা থাকে।

UK Election 2024: Postal Ballot Voting Rules Printed in Bengali

ব্রিটেনে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার নিয়মাবলি। ছবি: এক্স থেকে নেওয়া।

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বাঙালি বাবুল সুপ্রিয় অবশ্য কোনও তুলনায় যেতে চাননি। তবে জানিয়েছেন, তিনি কেন্দ্রে মন্ত্রী থাকার সময়ে তাঁর দফতরের কোনও নথি বাংলায় ছাপা হলে নিজে আগে দেখে নিতেন। সেই খুঁতখুঁতে বাবুল বিলেতের ভোটের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার বাংলা লিফলেটের শিরোনাম পড়ে বলছেন, ‘‘মাথাটাই তো ভুল! এর পর বাকি শরীরটা কী হবে বোঝাই যাচ্ছে! শিরোনামে লেখা রয়েছে ‘ভোট দেয়ার নিয়মাবলী’। কথাটা ‘দেওয়া’। বানানটা ‘দেয়া’ নয়।’’ অধুনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তিরসভার সদস্যকে বলা গেল, উত্তম-তনুজা অভিনীত ছবির নাম তো ‘দেয়া-নেয়া’ ছিল! বাবুলের পাল্টা যুক্তি, ‘‘চলিত ভাষায় অনেক কিছু বলা যায়। কিন্তু তা লেখা যায় না।’’ বিলেতের সেই বাংলা নিয়মাবলি আরও বিশদে পড়ে বাবুল সেটাই করেছেন, যা তিনি সচারচর করে থাকেন। পরামর্শ দিয়েছেন, ‘‘লন্ডনে তো অনেক শিক্ষিত বাঙালি রয়েছেন। তাঁদের পরামর্শ নিলে এই রকম বাংলা লেখা হত না।’’

কিন্তু দিল্লির বাংলা কি বিলেতের বাংলার চেয়ে সত্যিই ভাল? বাংলা থেকে এ বারেই প্রথম সংসদে যাওয়া বাঙালি সাংসদ তা মনে করেন না। কিন্তু মোদী সরকারের বাংলা ‘খারাপ’, এ তিনি প্রকাশ্যে বলেন কী করে! যদিও তিনি বিলেতের বাংলার সঙ্গে দিল্লির বাংলার তুলনায় যেতে চাননি। কিন্তু নাম গোপন রাখার শর্তে বলেছেন, ‘‘দিল্লি কেমন বাংলা লেখে তা আমার জানা আছে!’’ তিনিও ব্রিটেনের বাংলার সঙ্গে দিল্লির বাংলার তুলনা করতে চাননি। তবে বিদ্রুপের সুরে বলেছেন, ‘‘বাংলার বাসিন্দা এমন অনেক বাঙালি আছেন, যাঁরা লন্ডন বা দিল্লির বাংলার চেয়েও নিম্নমানের বাংলা লেখেন বা বলেন।’’ সে অবশ্য রাজনীতির কথা।

রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য তথা ভাষাবিদ পবিত্র সরকার অবশ্য ব্রিটেনের বাংলাকে ‘বাংলা’ হিসেবে অনেক ভাল বলেই মনে করছেন। লিফলেটটি পড়ার পরে তিনি বলছেন, ‘‘পড়ে মনে হল পূর্ববঙ্গের কেউ লিখেছেন। যে কারণে ‘দেবেন না’র বদলে ‘দিবেন না’ বা ‘স্টেটমেন্ট’-এর বদলে ‘স্ট্যাটমেন্ট’ লেখা রয়েছে। তা বাদ দিয়ে বাংলাটা তো সহজসরলই রয়েছে।’’ পাশাপাশিই তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভারত সরকারের অনেক নথি পড়ে মনে হয়, শুধু হিন্দির অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে। সে তুলনায় ব্রিটেনের বাংলাটা বাংলা হিসেবে অনেক ভাল।’’

UK Election 2024: Postal Ballot Voting Rules Printed in Bengali

কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের ২০২২ সালের একটি বার্তা। সেই সময়ে মন্ত্রী ছিলেন গিরিরাজ সিংহ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ব্রিটেনে থাকা অনেক বাঙালির কাছে মাতৃভাষায় লিফলেট পাওয়াটা অবশ্য ‘সম্মানজনক’। সে ভাষা বা বানানে ভুল-টুল যতই থাকুক। তাঁরা সেটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখতে চান। হুগলির কোন্নগরের বাসিন্দা সৈকত ভট্টাচার্য তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী। গত চার বছর ধরে লন্ডনে রয়েছেন। বিলেতের নাগরিক নন অবশ্য। কিন্তু লিলুয়া ডন বস্‌কোর প্রাক্তনী বলছেন, ‘‘বিভিন্ন বাঙালি হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে এটা নিয়ে আলোচনা দেখছি। এখানকার বাঙালিদের অনেকেই কিন্তু ব্যাপারটা পজ়িটিভলি (ইতিবাচক ভাবে) নিয়েছেন।’’ তবে পাশাপাশিই বিলেতের ভোটের পোস্টাল ব্যালট সংক্রান্ত নিয়মাবলিতে বিভিন্ন বানান ভুল ধরা পড়ছে অনেকের চোখে। যেমন, ১ নম্বর নিয়মে লেখা রয়েছে, ‘আপনার ভোট গণনা হতে হলে আপনাকে অবশ্যই পোস্টাল ভোটের স্ট্যাটমেন্ট বা বিবৃতি পুরণ করে ব্যালট পেপারের সাথে ফেরত পাঠাতে হবে।’ এই অংশে ‘পূরণ’ বানান তো বটেই, ইংরেজি ‘স্টেটমেন্ট’ শব্দটিরও যে বাংলা বানান লেখা হয়েছে, তা ঠিক নয়। ‘আপনার ভোট গণনা হতে হলে’-র অর্থ কী, তা-ও স্পষ্ট নয়। অনেকে বলছেন, সম্ভবত এগুলো ‘গুগ্‌ল অনুবাদ’ থেকে নেওয়া। ইদানীং ভাষান্তরের ক্ষেত্রে সেটিই সংক্ষিপ্ততম পন্থা। যদিও যে কোনও সংক্ষেপের মতোই তাতে প্রমাদের সম্ভাবনা প্রচুর।

তবে দিল্লিও কম যায় না। ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের একটি নথিতে দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রকের নাম লেখা অহমিয়ায়। আর তৎকালীন মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহের বার্তাটি লেখা বাংলায়। মন্ত্রীর নাম ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লিখতে গিয়ে ‘গিরিরাজ’ হয়ে গিয়েছেন ‘গিরিজা’। নাম তো বটেই, লিঙ্গও পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের এক অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি আমলার কথায়, ‘‘গুগ্‌ল অনুবাদ সমস্ত ভাষাকেই বিকৃত করে দেয়। সরকারের অনেক নথিতে সেটাই অনেক সময়ে ছাপা হয়ে যায়।’’ তাঁর মতে, এটা যত্নের অভাব। বাঙালির রাজ্যে ‘কান্ট্রি স্পিরিট’-এর বাংলা ‘দেশি মদ’-এর বদলে ‘দেশীয় আত্মা’ও সেই গুগ্‌ল অনুবাদেরই ‘দান’। যেমন হয়েছে বিলেতের বাংলার ক্ষেত্রে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement