কুন্তলের নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে চাকরিপ্রার্থীদের ‘মগজধোলাই’-এর বেশ কিছু পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ফাইল চিত্র ।
চিনার পার্কের কাছে অভিজাত বহুতল আবাসনে কুন্তল ঘোষের সঙ্গে যোগসূত্রে একটি ফ্ল্যাটই এখন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-র নজরে। ইডি সূত্রে খবর, ওই ফ্ল্যাটই নিয়োগ দুর্নীতির অন্যতম ‘যন্তরমন্তর ঘর’। ওই ঘরেই নিয়োগ দুর্নীতির বেশ কিছু পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
‘যন্তরমন্তর ঘর’ শব্দবন্ধের সঙ্গে বাঙালি জনতার পরিচয় সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশ’ ছবির মাধ্যমে। ওই ছবির অন্যতম চরিত্র গবেষক সেই ঘরেই ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র’, সোজা কথায় ‘মগজধোলাই’-এর যন্ত্র বসিয়েছিলেন। যার ভিতরে ঢুকিয়ে জনতার মগজধোলাই করা হত। তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অধিকারিকেরা মনে করছেন, কুন্তলের নিউ টাউনের ফ্ল্যাটে চাকরিপ্রার্থীদের ‘মগজধোলাই’-এর বেশ কিছু পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
গত শুক্রবার সকালে ওই আবাসনের দু’টি ফ্ল্যাটে একসঙ্গে হানা দিয়েছিল ইডির দু’টি দল। তারই একটি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে একাধিক নথি। উদ্ধার করা হয়েছে একটি নোটবুকও। ইডি সূত্রের খবর, নথিগুলি মিলেছে বিছানার তলা এবং তোশকের ভিতরে। সেই নথিতে ‘দুর্নীতির ছাপ’ স্পষ্ট বলেও ইডি সূত্রের দাবি। ইডি আধিকারিকরা মনে করছেন, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, তার বেশ কিছু পরিকল্পনা হয়েছিল ওই ফ্ল্যাটেই। ওই ফ্ল্যাটে বিভিন্ন সময়ে যাতায়াত ছিল নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত অনেকের। অন্তত তেমনই মনে করছেন ইডি আধিকরিকেরা। বস্তুত, তাপসের যে সহযোগীর বিরুদ্ধে কুন্তল ‘হুমকি’ দিয়ে টাকা হাতানোর অভিযোগ এনেছিলেন, সেই নীলাদ্রি ঘোষও দাবি করেছেন, ওই ফ্ল্যাটে ডেকেই তাঁর হাতে দু’লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছিলেন কুন্তল। ওই ফ্ল্যাটে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে টাকার লেনদেন হয়েছিল কি না, কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিকেরা তা-ও খতিয়ে দেখতে তৎপর হয়েছেন।
নিউ টাউনের আবাসনের একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে ইডির হাতে ধৃত হুগলির তৃণমূল যুবনেতা কুন্তল। কিন্তু যুবনেতার স্ত্রী জয়শ্রী ঘোষের দাবি, যে ফ্ল্যাট থেকে নথিগুলি উদ্ধার হয়েছে, লকডাউনের সময় সেই ফ্ল্যাটে দীর্ঘ সময় থেকেছেন নিয়োগ দুর্নীতিতে অন্যতম অভিযুক্ত তাপস মণ্ডল। তাপস যে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন, তার যথেষ্ট ‘প্রমাণ’ ওই ফ্ল্যাটের যত্রতত্র পড়ে রয়েছে বলেও দাবি করেছেন জয়শ্রী। যদিও তাপসের পাল্টা দাবি, ওই ফ্ল্যাটে ‘যাতায়াত’ থাকলেও তিনি ওখানে থাকতেন না। ইডি সূত্রে খবর, তাপসের যে ওখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল এবং তিনি ওখানে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন, তার প্রমাণ মিলেছে। তাপসও তা স্বীকার করেছেন। প্রয়োজনে ওই ফ্ল্যাটের বিভিন্ন জিনিসপত্রের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাও করা হতে পারে।
তাপস-কুন্তলের অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগে বার বার উঠে এসেছে তিনটি নাম— নীলাদ্রি ঘোষ, তাপস মিশ্র এবং গোপাল দলপতি। সেই তাপস মিশ্রও লকডাউনের সময় তাপস মণ্ডলের সঙ্গে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন বলে দাবি করেছেন যুবনেতা কুন্তলের স্ত্রী। তাঁকে একাধিক বার তলবও করেছে ইডি। তাপস মিশ্রের খোঁজ এখনও মেলেনি। তাঁর খোঁজ চালানো হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের ‘ঘনিষ্ঠ’ তাপস (মণ্ডল) নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত। তাঁকে দফায় দফায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিবিআই এবং ইডি। সম্প্রতি তাপস দাবি করেন, হুগলির তৃণমূল যুবনেতা কুন্তল চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে প্রাথমিকের চাকরিপ্রার্থীদের থেকে ১৯ কোটি টাকা নিয়েছেন। এর পরই তদন্তে নেমে কুন্তলকে গ্রেফতার করে ইডি। গ্রেফতারির পর কুন্তলের দাবি, তিনি কারও কাছে টাকা নেননি এবং তিনি কোনও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। উল্টে তাপস এবং তাঁর কিছু ‘তোষামোদকারী’ বিভিন্ন সময়ে হুমকি দিয়ে কুন্তলের কাছে টাকা আদায় করেছেন। একই অভিযোগ করেছেন কুন্তলজায়াও। যদিও ইডি সূত্রে খবর, জেরার সময় কুন্তল দাবি করেছেন, তিনি চাকরিপ্রার্থীদের থেকে সরাসরি টাকা না নিলেও পুরো প্রক্রিয়ায় ‘কমিশন’ হিসাবে ১০ শতাংশ নিয়েছেন। ইডি আদালতে দাবি করেছে, কুন্তল তাঁদের ভুল তথ্য দিয়ে বিপথে চালিত করছেন। কুন্তল টাকা নিয়েছেন কি না বা তাঁর কাছ থেকে টাকা অন্য কোথাও গিয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে ইডি সূত্রে খবর।