বাংলার জয়ের সঙ্গে জুড়ে গেল ‘জয় বাংলা’। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
আগামী বছর বিধানসভা ভোট। সেই ভোটেও যে ‘বাঙালি অস্মিতা’ই তৃণমূলের ‘অস্ত্র’ হবে, তা স্পষ্ট হয়ে গেল বর্ষবরণের রাতে। তৃণমূলের রাজনৈতিক স্লোগানে পরিণত হওয়া ‘জয় বাংলা’ জুড়ে গেল বাংলা ফুটবল দলের সন্তোষ ট্রফি জয়ের সঙ্গে। রবি হাঁসদা, চাকু মান্ডিদের সৌজন্যে ছ’বছর পরে বাংলার সন্তোষ ট্রফি জয় হয়ে উঠল তৃণমূলের রাজনৈতিক স্লোগানের নতুন অভিজ্ঞান।
সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার সময় ভাল যাচ্ছিল না। মাঝে দু’বার ফাইনালে উঠেও হারতে হয়েছিল। তবে এ বার শুরু থেকেই সঞ্জয় সেনের ছেলেরা ছিলেন দুরন্ত ছন্দে। ফাইনালে কেরলের বিরুদ্ধে নির্ধারিত ৯০ মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরে ‘স্টপেজ টাইমে’ রুদ্ধশ্বাস গোলে ৩৩তম সন্তোষ ট্রফি জেতে বাংলা। দ্রুত ‘বাংলার জয়’ রূপান্তরিত হয় ‘জয় বাংলা’য়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কুণাল ঘোষেরা সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে অভিনন্দন জানান বাংলার ফুটবল দলকে। মমতা ছাড়া বাকি প্রায় সকলেই তাঁদের বার্তায় লেখেন ‘জয় বাংলা’। রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস যে অভিনন্দনজ্ঞাপক বিবৃতি দিয়েছেন, তাতেও রয়েছে ‘জয় বাংলা’।
অভিষেক যেমন বাংলা দলকে অভিনন্দন বার্তার মধ্যেই জানান দিয়েছেন, তাঁর ক্লাব ‘ডায়মন্ড হারবার এফসি’র ছ’জন ফুটবলার ছিলেন স্কোয়াডে। শেষে তিনি ‘জয় বাংলা’ উল্লেখ করেছেন (বাহুপেশি ফোলানোর ইমোজি-সহ)। কুণাল তাঁর পোস্টের শুরুতেই লিখেছেন, ‘সন্তোষেও জয় বাংলা’। যার অর্থ স্পষ্ট। তৃণমূলের একাধিক ছাত্র-যুব নেতা-নেত্রীও সন্তোষ ট্রফি জয়ী বাংলা দলের ছবি দিয়ে লিখেছেন ‘জয় বাংলা’। কেউ কেউ দলের আরও একটি স্লোগান ‘খেলা হবে’কেও মিশিয়ে দিতে চেয়ে লিখেছেন, ‘খেলা হল, জয় বাংলা’।
পুরো বিষয়টাকেই অবশ্য ‘যুক্তিহীন’ বলেছেন প্রাক্তন ফুটবলার ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলার জয়ের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’র কোনও সম্পর্ক নেই। এটা না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। খেলাধূলায় রাজনৈতিক স্লোগান জুড়ে দেওয়া উচিত নয়।’’ প্রাক্তন ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্যেরও বক্তব্য, ‘‘এই ধরনের প্রবণতা খেলোয়াড়দের মনোবলকে আঘাত করে। এগুলো শোভনীয় নয়।’’ যদিও আর এক প্রাক্তন ফুটবলার মানস ভট্টাচার্য এর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলা জিতলে ‘জয় বাংলা’ বললে অসুবিধা কী আছে? এটাকে রাজনৈতিক স্লোগানের মোড়কে দেখা ঠিক হবে না।’’
বিরোধী শিবিরের রাজনীতিকেদেরও বক্তব্য, তৃণমূল তাদের রাজনৈতিক স্লোগানকে প্রচার করতে ‘শিখণ্ডী’ করছে সন্তোষ ট্রফি জয়কে। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম খানিকটা প্রাক্তন ফুটবলার ভাস্করের সুরেই বলেছেন, ‘‘জয় বাংলা আর বাংলার জয় এক নয়।’’ সঙ্গে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘বাংলা দলকে ‘মমতা একাদশ’ বলে উল্লেখ করেনি, এই না কত!’’ রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র তরুণজ্যোতি তিওয়ারির বক্তব্য, ‘‘বাংলা সন্তোষ ট্রফিতে জিতেছে, এটা আনন্দের বিষয়। তবে এর মধ্যে রাজনীতি আনা উচিত নয়। কিন্তু তৃণমূল তো তৃণমূলই। অন্নপ্রাশন থেকে শ্রাদ্ধ— সবেতে রাজনীতি জুড়তে চায়। এখানেও তাই করেছে।’’ তৃণমূল অবশ্য এ সবে পাত্তা দিতে চায়নি। শাসকদলের নেতা কুণালের (যিনি ঘটনাচক্রে মোহনবাগানের সহ-সভাপতিও বটে) সোজা কথা, ‘‘সন্তোষ ট্রফি জিতেছে কে? বাংলা। তা হলে ‘জয় বাংলা’ বলব না তো কী বলব? যাদের গায়ে লাগছে তারা বুঝুক। আমাদের কিছু যায়-আসে না।’’ তৃণমূলের এক তরুণ নেতা অবশ্য মানছেন, ‘‘বাংলার সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়া ‘জয় বাংলা’ ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে। সেই সুযোগ সকলে নিয়েছেন।’’
২০২১ সালের ভোটে বাঙালি অস্মিতাকে অস্ত্র করে বিজেপির ‘মেরুকরণ’ ভাঙতে সফল হয়েছিল তৃণমূল। সেই ভোট থেকেই ‘জয় বাংলা’ হয়ে গিয়েছে তৃণমূলের স্লোগান। তার আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রেক্ষিতেই তা ব্যবহৃত হত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে স্লোগান দিয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমান। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও বাংলার শাসকদলের প্রচারের ‘লাইন’ ছিল বাঙালি অস্মিতাই। স্লোগান দেওয়া হয়েছিল, ‘জনগণের গর্জন, বাংলা বিরোধীদের বিসর্জন’। বাংলার সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়াকে সেই আঙ্গিকেই ব্যবহার করতে চেয়েছে তৃণমূল। যা থেকে স্পষ্ট, ২০২৬ সালের ভোটেও বাঙালিয়ানাকেই ‘অস্ত্র’ করবে শাসকদল।
ফুটবলে রাজনীতি বা রাজনীতিতে ফুটবল, এ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। বাংলা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ফুটবলের আঙিনার ইতিহাসে বিভিন্ন ঘটনা রয়েছে। বিশেষত, ফুটবল মাঠের গ্যালারির সঙ্গে রাজনীতির যোগ ওতপ্রোত। ২০১৯ সালে যখন এনআরসি-সিএএ নিয়ে দেশ উত্তাল, তখন যুবভারতীর গ্যালারি থেকে আই লিগের ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে ‘টিফো’ ঝুলেছিল। সাদার উপর কালো অক্ষরে তাতে লেখা ছিল— ‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়’। ২০২২ সালে কাতারে যখন বিশ্বকাপ চলছে, তখন হিজ়াব বিধি নিয়ে কড়াকড়ি করছে ইরান। বিশ্বকাপে ইরানের একটি ম্যাচে এক ইরানি তরুণী হিজাব খুলে পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন গ্যালারিতে। যাতে লেখা ছিল— ‘উইমেন, লাইফ, ফ্রিডম’। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ ক্লাব ইস্ট ইয়র্কসায়ারকে হারিয়ে মোহনবাগানের ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড জয়ের সঙ্গেও সেই সময়ে জুড়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ। যাতে রাজনীতি কম ছিল না।
বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গেও ফুটবল জড়িয়ে রয়েছে নিবিড় ভাবে। ১৯২১ সালে আন্তোনিও গ্রামসি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি। সে পার্টির গণভিত্তি ছিল ‘লিভরনো’। আর ফুটবল পাগল লিভরনো ক্লাব হয়ে উঠেছিল কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটা ‘ফর্ম’। একটা সময়ে ‘সিরিয়া এ’ লিগ খেলত লিভরনো। এখন ‘বি ডিভিশন’ খেলে। কিন্তু রাজনৈতিক দর্শনে ক্লাবের অবস্থান এখনও একই। এখনও টিম মাঠে নামলে গ্যালারি উপচে যায়। আর সেখানে ওড়ে কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পতাকা।