(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।
লড়াইয়ের শুরু গান দিয়ে। সেই লড়াই বৃহস্পতিবারের মতো থামল স্লোগান যুদ্ধের পরে। বৃহস্পতিবার বাজেট পেশের আগে বাংলার রাজ্য সঙ্গীত ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ বাজাতে বলেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মতো গান বাজতে শুরু করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গাইতে শুরু করেন বিজেপি বিধায়করা। গলা মিলিয়ে নেতৃত্ব দেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই গান নিয়ে দুই শিবিরের লড়াই বাঁধে। বিধানসভার ভিতরে ২১৫ বনাম ৭৪-এর শাসক-বিরোধী লড়াইয়ের শুরু এই ভাবেই।
বিষয়টিতে রেগে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় সঙ্গীত আমরাও গাই, তবে সবচেয়ে শেষে। এই ভাবে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অসম্মান করেছে বিজেপি। এই ঘটনার নিন্দা করছি।’’ মুখ্যমন্ত্রীর কথার প্রসঙ্গ টেনেই বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিজেপির নিন্দা করেন। বাজেট পেশ হয়ে যাওয়ার পরে শুভেন্দু আবার অন্য অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, ‘‘বিধানসভায় রাজ্যের জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে বলা হয়েছিল। জাতীয় সঙ্গীত তো একটাই হয়।’’ তবে অধিবেশন কক্ষে স্পিকার বিজেপি বিধায়কদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আমি মহারাষ্ট্রে অল ইন্ডিয়া স্পিকার সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেখানেও অনুষ্ঠান শুরুর আগে সেই রাজ্যের সঙ্গীত গাওয়া হল।’’ উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্র সরকার বর্তমানে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ দ্বারা পরিচালিত। তাই রাজ্য রাজনীতির কারবারিদের একাংশের মতে, মহারাষ্ট্রের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যেও যে রাজ্য সঙ্গীতের গুরুত্ব রয়েছে, তাই বোঝাতে চেয়েছেন বিমান।
এর পর অর্থমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে বাজেট বক্তৃতার সময়ে পদে পদে বাধা দেন বিজেপি বিধায়কেরা। বিরোধী শিবির থেকে বার বার ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিও শোনা যায়। একটা সময়ে শুভেন্দুকে নাম করে শান্ত হতে বলেন স্পিকার। শুভেন্দুকে স্মরণ করিয়ে দেন, তিনি বিরোধী দলনেতা হিসাবে সম্মানজনক পদে রয়েছেন। বিমান বলেন, ‘‘শুভেন্দুবাবু আপনি বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেন, বসুন। দয়া করে এটা করবেন না, এটা আপনাদের শোভা পায় না।’’ স্পিকারের এমন নির্দেশ অবশ্য কানেও তোলেননি বিজেপি বিধায়কেরা। স্পিকার বক্তৃতা চালিয়ে যেতে বললেও বার বার চন্দ্রিমাকে থেমে যেতে হয়।
এমনটা চলতে থাকায় রেগে চন্দ্রিমাকে থামান স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। মমতা দাঁড়িয়ে পড়ে রাগত ভঙ্গিতেই বিজেপির নিন্দা করতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘‘এটা বিজেপির পার্টি অফিস নয়। এটা বিধানসভা।’’ এর আগে বিজেপি বিধায়কদের পাল্টা তৃণমূলের অনেকেই স্লোগান তোলেন। সেই প্রসঙ্গে মমতা বলেন, ‘‘বাজেট সম্পর্কে সমালোচনা করার অধিকার আপনাদের রয়েছে। আমি যখন বলছি, আমাদের লোকেরা কেউ কথা বলবেন না, ওদের সঙ্গে মুখ লাগাবেন না। আমি বলছি, বাজেটটা পেশ করুক সরকার, আপনাদের কেন্দ্রীয় সরকারও করে। সবাই শোনে মন দিয়ে, তার পরে আমাদের সমালোচনা আমরা করি, যখন আমাদের বলার সময় আসে।’’ এর পরে নাম না করেই মমতা শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘আপনি বলতে দিচ্ছেন না কেন, তার মানে কি আপনি ভয় পাচ্ছেন?’’ হুঁশিয়ারির সুরও ছিল মমতার গলায়। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সরকারের বাজেট, আমাদের পেশ করতে দিন। যদি পেশ করতে না দেন, সংসদেও বাজেট আমরা পেশ করতে দেব না, এটা মনে রাখবেন, শিক্ষা নেবেন।’’ পরে আবার শুভেন্দু সাংবাদিক বৈঠক থেকে এর জবাব দেন। তিনি চ্যালেঞ্জের সুরে বলেন, ‘‘এখনও দু’দিন সংসদ চলবে। ক্ষমতা থাকলে বানচাল করে দেখাক তৃণমূল।’’
সে সবের শেষে আর একপ্রস্ত গোলমাল শুরু হয় বিধানসভা চত্বরে। শুভেন্দু তখন গেটের কাছে গাড়িতে উঠে পড়েছেন। আচমকা বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল এসে জানান, তাঁর গাড়ি বার করা যাচ্ছে না। সেই সময়ে মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধির জন্য বিধানসভা চত্বরে মমতার নামে জয়ধ্বনী দিতে থাকেন রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের একাংশ। তাঁরা অগ্নিমিত্রার গাড়ি ঘিরে রেখেছেন বলে অভিযোগ। শুনেই শুভেন্দু গাড়ি থেকে নেমে অগ্নিমিত্রার সঙ্গে যান। এ বার স্লোগান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এক দিকে তৃণমূলপন্থী সরকারি কর্মচারীরা ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছেন। অন্য দিকে, ‘চোর চোর’ স্লোগান তুলে চলেছেন বিজেপি বিধায়কেরা। জোর টক্কর চলতে থাকে বেশ কিছু ক্ষণ। তবে বিজেপি বিধায়কেরা সকলে বার হয়ে গেলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তবে এটা আপাত শান্তির আবহ। কারণ, গোটা দিনের যুদ্ধ এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে, বাজেট অধিবেশনের বাকি দিনগুলিতে সুপবন বইবে না বিধানসভায়।