Movie Review

ভয়ের সীমানা পার করে নুহাশের ‘দুই ষ’ নিয়ে যায় অনির্দেশ্য এক দুনিয়ায়, এ সিরিজ় সত্যিই অ-পূর্ব!

নুহাশ কি হরর ঘরানার বেড়া ডিঙিয়ে এমন কোনও চিত্রভাষাকে উপস্থাপন করতে চাইছেন, যা এতৎকালে এশীয় (এবং পশ্চিমি) পরিসরে কখনও ব্যবহৃত হয়নি?

Advertisement
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৪৭
Review of the web series Dui Shaw by Nuhash Humayun

রাজনীতি থেকে লোকবিশ্বাস, পুরাণ থেকে হরর... ‘দুই ষ’-এর পরিধি বহুস্তরীয়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

‘শয়তান’ শব্দটির শুরুতে রয়েছে ‘শ’। ‘তার প্রতিশব্দ ‘ইবলিশ’-এর শেষে রয়েছে ‘শ’। কিন্তু ‘মানুষ’ শব্দটি শেষ হয় ‘ষ’ দিয়ে। এইখানেই নাকি শয়তান বা ইবলিশের সঙ্গে মানুষের ফারাক। এমন এক ‘প্রবাদ’কে তিলে তিলে নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশের তরুণ পরিচালক নুহাশ হুমায়ুন। আর সেই প্রবাদটিকেই তিনি বুনেছেন তাঁর সাম্প্রতিক ওয়েব সিরিজ় ‘২ ষ’-এ। এর আগে তাঁর প্রথম সিরিজ় ‘পেট কাটা ষ’-এ নুহাশ চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে তুলে ধরেছিলেন যে ভয়ের রাজপাটকে, তার মধ্যে একটিতে ইবলিশের উপস্থিতি ছিল। বাকি তিনটির কাহিনি ছিল বাংলার প্রাচীন কিছু কহাবতকে নিয়ে। কিন্তু এ বার নতুন সিরিজ়ে বাংলা আছে, বাংলাদেশ আছে, বাঙালি আছে তার যাবতীয় স্মৃতি-বিস্মৃতি এবং আনুষঙ্গিক নিয়ে। সর্বোপরি রয়েছে ইবলিশ। স্বর্গ থেকে পতিত দেবদূত, ‘দ্য ফলেন অ্যাঞ্জেল’। রয়েছে মানুষের সঙ্গে তার বোঝাপড়া, ইবলিশি মায়া, ফাউস্টিয় চুক্তির ইঙ্গিত। চরিত্রগত ভাবে ‘২ ষ’ তার প্রথম সিজনের চাইতে একেবারেই আলাদা। চিত্রভাষা, বক্তব্য, ইশারা ও চলনে এতখানি আলাদা এবং সর্ব অর্থে ‘নতুন’ যে, এ সিরিজ় দেখতে বসে স্তম্ভিত হতে হয়। সিনেমার চেনা ভাষার সঙ্গে বিরাট দূরত্ব নুহাশের মনোবিশ্বের। ফলে, যে প্রাথমিক ধাক্কাটি দর্শক অনুভব করেন, সিরিজ়ের শেষ পর্যন্ত তা তাঁদের ধাওয়া করে এবং শেষ হওয়ার পরেও তা এক বিপুল অস্বস্তি রেখে যায়।

Advertisement

নুহাশের ‘২ ষ’ সর্ব অর্থেই নতুন। তার এক দিকে যেমন ইসলামি বা সেমিটিক পুরাণ রয়েছে, অন্য দিকে রয়েছে বাংলার নিজস্ব মাটির ঘ্রাণ। সমান্তরালে, এ সিরিজ় বা চারটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি নিজেদের চারিয়ে দিয়েছে বাংলার সংস্কৃতির গভীরে, গ্রামীণ সুর, কারুশিল্প, বিশ্বাস ও মনোগহিনে। সেই সব পরিসরে থেকে যাওয়া আতঙ্কের বহিঃপ্রকাশকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে ‘২ ষ’ এমন সব রাস্তায় হেঁটেছে যার সঙ্গে এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ভাষার তেমন কোনও পূর্বাপর সম্পর্ক নেই। পাপবোধ, বিশ্বাস, বিস্মরণ এবং পুরাণ-ঘটিত অধিবাস্তবতা শিকড় বিস্তার করেছে ‘ওয়াক্ত’, ‘ভাগ্য ভালো’, ‘অন্তরা’ এবং ‘বেসুরা’ নামের চারটি ছবিতে। একই সঙ্গে চারটি ছবিতেই জড়িয়ে রয়েছে রাজনীতি। উল্লেখ্য, ‘পেট কাটা ষ’-এ রাজনৈতিক ইঙ্গিত অনুপস্থিত ছিল। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিই কি নুহাশকে নিয়ে গেল এই উচ্চারণের দিকে? প্রশ্ন জাগে।

সিরিজ়ের প্রথম ছবি ‘ওয়াক্ত’-এ পাঁচ যুবক মুখোশ পরে এক পার্টি অফিসে ভাঙচুর করে এবং আগুন লাগায়। আগুন ছড়িয়ে পড়ায় আশপাশের কয়েক জন মানুষ মারা যায়, তাদের মধ্যে এক মুয়াজ্জিনও ছিল, যে মসজিদে আজান দিত। কুকর্ম সেরে যুবকেরা ডেরায় ফিরে আসে। ফজরের আজানের সময় এক যুবক তার ভাল লাগা এক মেয়েকে তার ঘরে দেখতে পায় এবং তাকে স্পর্শ করতে যেতেই অন্ধকার…। পরের শটে দেখা যায়, তার বন্ধুরা তাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে। পরে আর এক যুবককে বাড়িতে তার মায়ের সঙ্গে ভাত খেতে দেখা যায়। বন্ধুরা ফোন করে তাকে মৃত বন্ধুর কথা জানালে সে বলে সে তার আম্মার সঙ্গে ভাত খাচ্ছে। বন্ধুরা বিস্মিত হয়। কারণ, তার মা কয়েক মাস আগে মারা গিয়েছে। ও দিকে মসজিদে তখন জোহরের নমাজে আজান দেওয়া হচ্ছে। সেই আজানধ্বনি বন্ধুদের কানে আসে। সেই যুবকটিও মারা যায় অদ্ভুত বিভ্রমের মধ্যে দিয়ে, যেখানে সে দেখে তার মা তাকে মাংস আর ভাত খেতে দিচ্ছে, কিন্তু তার মুখে ঢুকছে পাথর। পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে মা তাকে হজযাত্রায় এক পাপী মানুষের অভিজ্ঞতার কথা শোনায়, যেখানে তাকেই ইবলিশ ভেবে পাথর ছুড়ে মারে। সেই যুবকও মারা যায় পাথরে পরিণত হওয়া ভাত আর মাংস খেতে খেতে। তার মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছয় বন্ধুদের কাছে। এ বার তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আসর ও মগরিবের আজানের সময় দুই যুবক আত্মহত্যা করে। এক মৌলবি তাদের বুঝিয়েছিলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নমাজের আজানের কালে শয়তান বিদায় নেয়।

Review of the web series Dui Shaw by Nuhash Humayun

‘ওয়াক্ত’ পর্বের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

শেষ যুবকটি অনুভব করে, তাদের কৃতকর্ম আদতে ইবলিশি। সে ইশার নমাজের আজান থেকে পালাতে চায়, আশ্রয় নেয় এক সাউন্ডপ্রুফ স্টুডিয়োর ভিতরে। কিন্তু সেখানে গিয়েও সে পরিত্রাণ পায় না। নিয়তি তাকে আজান শোনায় এবং তার মৃত্যু ঘটে।

দ্বিতীয় ছবি ‘ভাগ্য ভালো’ এক ফুটপাত জ্যোতিষীর গল্প। সে লোকের ভাগ্য বিচার করে, কিন্তু নিজে দারিদ্রের মধ্যে বাস করে। মায়ের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতেও সে ব্যর্থ। জ্যোতিষের দুনিয়ায় যে গণকের নিজস্ব ভাগ্যবিচার নিষিদ্ধ, এ কথা বিশ্বাস করে সেই জ্যোতিষী। কিন্তু ঘটনাচক্র তাকে নিজের ভাগ্যবিচারের দিকে নিয়ে যায়। নিজের ভাগ্যরেখাকে বদলাতে চায় সে। একদিন ভাগ্যের চাকা ঘোরে, সে নিজের ভাগ্যবিচার করে বসে। তার পোষা তোতাপাখি তাকে বার বার বলে, ‘পর্দা সরাইস না’, কিন্তু সে তত ক্ষণে সম্ভব আর অসম্ভবের, কর্তব্য এবং অকর্তব্যে মধ্যেকার পর্দা সরিয়ে ফেলেছে। ক্রমশ তার দুর্দিন ঘোচে, পাশাপাশি সে তার নৈতিক বন্ধনকেও শিথিল করে ফেলে। কিন্তু তার মায়ের শরীর আরও খারাপ হয়, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তার মা তাকে বলে— ‘পর্দা সরাইস না’। অথচ সে তত ক্ষণে পর্দা সরিয়ে ফেলেছে। এক ইবলিশি কেতাবের সহায়তা নিয়ে সে শয়তানকে আহ্বান করে। শয়তান তাকে জানায়, ভাগ্য এক ধরনের শক্তি, যার ক্ষয় বা বিনাশ নেই। ভাগ্য শুধু হাতবদল করে। শয়তান আরও জানায়, জ্যোতিষী নিজের ভাগ্য বদল করছে না, সে তার চারপাশের লোকের ভাগ্য শুষে নিচ্ছে। শয়তান বিষয়টার তুলনা করে পুঁজিবাদের সঙ্গে। সরলার্থে, পুঁজিবাদী ‘শোষণ’-এর সঙ্গে। এ ছবির অন্তিম ভাগ ভয়াবহ। ঘোরতর রাজনৈতিক এবং বহুমাত্রিক ইঙ্গিতবাহী। এক আগুনে ঝলসাতে থাকা দেশের ভাগ্য ‘শুষে’ নিচ্ছে এক সুবিশাল ইমারত। তারই এক প্রকোষ্ঠে দাঁড়িয়ে রয়েছে জ্যোতিষী।

Review of the web series Dui Shaw by Nuhash Humayun

‘ভাগ্য ভালো’ পর্বে মোশারফ করিম। ছবি: সংগৃহীত।

তৃতীয় গল্প ‘অন্তরা’ পূর্ববর্তী সিজন ‘পেট কাটা ষ’-এর ‘মিষ্টি কিছু’ পর্বটির উপসংহার। সেই ছবিতে দেখা গিয়েছিল এক ভুলোমন মিষ্টির দোকানের মালিকের কাছে এক রাতে ইবলিশ আসে এবং মিষ্টি খেতে চায়। পরিবর্তে সে তাকে অবিশ্বাস্য স্মরণশক্তি দান করে। একদিন মিষ্টির দোকানের মালিক অহমিকা প্রকাশ করে শয়তানকে তাচ্ছিল্য করলে তার জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়, সে যাত্রা করতে শুরু করে স্মৃতিসরণির পিছনবাগে। জন্মমুহূর্ত, গর্ভাবস্থা পেরিয়ে সে আদিতে পৌঁছতে চায়। সৃষ্টির আদিতে। কিন্তু সেই মহা অন্ধকারে কারও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। অবধারিত ভাবে সে মারা যায়। তার পারলৌকিক কাজের দিন ইবলিশ এসে তার স্ত্রী অন্তরাকে জানায়, সে অপছন্দের স্মৃতি লোপ করে দিতে পারে। ‘দুই ষ’-এর ‘অন্তরা’ পর্বটি শুরুই হয় অন্তরা ও শয়তানের একত্রবাস দিয়ে। অন্তরা শয়তানের পরিচর্যা করে, এক সুখী গৃহবধূর জীবন যাপন করে। তার ফেলে আসা জীবনের কোনও কথাই আর মনে নেই। কিন্তু একদিন তার জীবনেও পর্দা সরে যায়। সে ইবলিশি মায়ার স্বরূপ বুঝতে পারে এবং সেখান থেকে মুক্তি চায়। মুক্তি কী ভাবে পাবে সে? কাহিনি এমন দিকে মোড় নেয়, যেখানে বাস্তব, অধিবাস্তব এবং অতিপ্রাকৃত মিলেমিশে একাকার।

Review of the web series Dui Shaw by Nuhash Humayun

‘অন্তরা’ পর্বে আফজ়াল হোসেন। ছবি: সংগৃহীত।

সিরিজ়ের অন্তিম ছবি ‘বেসুরা’। এ ছবির ভাষা, আঙ্গিকের সঙ্গে আগের তিনটি ছবির কোনও মিলই নেই। এখানে কাহিনি নীতিকথার আঙ্গিকে কথিত, সংলাপ ছন্দে রচিত। এক গ্রামের সকলেই প্রতিভাবান। নাচে, গানে চারুকলায় সবাই দক্ষ। কেবল এক বালিকা এ সবের কিছুই পারে না। তার গলায় সুর নেই, নাচে ছন্দ নেই। গ্রামপ্রধান নিদান দেয় এক দিনের মধ্যে যদি সে গলায় সুর আনতে না পারে, তাকে কসাইদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। কসাইদের হাত এড়িয়ে সেই বালিকা পালিয়ে যায় বনে। বন তাকে নির্দেশ দেয় ডাইনির কাছে যেতে। অরণ্য ভেদ করে সে পৌঁছয় ডাইনির কাছে। ডাইনি তাকে কিছু একটা দান করে। সে ফিরে আসে গ্রামে। আবার তাকে কসাইরা কব্জা করে। তাকে জবাই করতে চায়। কারণ, গ্রামে ‘বেসুরা’র কোনও স্থান নেই। এমন সময়ে সে সঠিক সুরে গান গেয়ে ওঠে। গ্রামবাসীদের চাপে জানায় ডাইনির কথা। তাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামবাসীরা গিয়ে ডাইনিকে ধরে নিয়ে আসে। ডাইনিকে বেঁধে রেখে তার কাছ থেকে চায় আরও সুর, আরও কলাকুশলী হয়ে ওঠার উপায়, চায় যশ, প্রতিষ্ঠা, পুরস্কার। কিন্তু ডাইনির জাদুতে তারা সবাই মারা পড়ে। বেঁচে থাকে কেবল সেই বালিকা আর তার মা। ডাইনির বাঁধন তারা খুলে দিতেই ডাইনি রূপান্তরিত হয় অপরূপা এক নারীতে। সেই নারী জানায়, সে-ই প্রথম মানবী, যে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেয়ে তার বীজ ফেলেছিল গ্রামের মাটিতে। মুক্ত সেই নারী এ বার যাত্রা করে অনির্দেশ্য পথে। তাকে বহন করে এক গ্রামীণ ভটভটি যান। আবার সে বার করে নিষিদ্ধ ফল। কামড় বসায় তাতে।

Review of the web series Dui Shaw by Nuhash Humayun

‘বেসুরা’ পর্বের একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

এই চারটি ছবির কাহিনির মধ্যে সাধারণ সূত্রটি হল নীতিবাক্য। ইবলিশ আর মানুষের টানাপড়েন। সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে মানুষের কৃতকর্ম অথবা ইবলিশের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তার গুনাগার দেওয়া। সমান্তরালে নুহাশ বুনে গিয়েছেন রাজনৈতিক বয়ান। প্রথম ছবিতে রাজনৈতিক অন্তর্ঘাত আর সূত্রে সাধারণের প্রাণহানির ঘটনা। দ্বিতীয় ছবিতে একটি দেশের সমস্ত সৌভাগ্য শুষে নিচ্ছে এক ইবিলিশি মিনার। তৃতীয় ছবিতে ইবলিশের শুষে নেওয়া মানবিক স্মৃতি আর তার পরাজয়। এখানেই তো শেষ হতে পারত বৃত্ত। কেন শেষ ছবিতে লোকনাট্যের আঙ্গিকে নুহাশ দেখালেন প্রথম মানবীকে? আগের তিনটি ছবির মধ্যে যোগসূত্র রেখে গিয়েছেন নুহাশ, যে মুখোশগুলি পরে পাঁচ যুবক পার্টি অফিসে আগুন লাগাতে গিয়েছিল, সেই মুখোশগুলিই কয়েকটি শিশুকে পরতে দেখা যায় দ্বিতীয় ছবিতে। আবার সেই মুখোশ ফিরে আসে তৃতীয় ছবিতে ইবিলিশের ব্যক্তিগত মেহফিলে বাদকদের মুখে। ‘অন্তরা’ ছবিতে এক বালিকা ইবিলিশকে প্রশ্ন করে— “শয়তান কি বাংলাদেশে থাকে?” উত্তরে ইবলিশ বলে ওঠে— “আর কোথায় থাকবে!” এ কি দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থতির উপর রচিত এক ভাষ্য? না কি এই উপমহাদেশ, বা আরও প্রসারিত করে দেখলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ভাগ্যের উপরে রচিত কিছু ‘ফেব্‌ল’? অন্তিম ছবিতে যে কস্টিউম আর মেকআপ ব্যবহৃত হয়েছে, তা যেন দক্ষিণ এশিয়ার যাবতীয় সংস্কৃতি থেকে আহৃত। তাকে নিছক বাংলাদেশের গণ্ডিতে ফেলে দেখা যাবে না। নুহাশ কি হরর ঘরানার বেড়া ডিঙিয়ে এমন কোনও চিত্রভাষাকে উপস্থাপন করতে চাইছেন, যা এতৎকালে এশীয় (এবং পশ্চিমি) পরিসরে কখনও ব্যবহৃত হয়নি?

এর আগে ‘ফরেনার্স অনলি’ নামের এক স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে নুহাশ তুলে এনেছিলেন আফ্রো-ক্যারিবিয়ান রাষ্ট্রদার্শনিক ফ্রাঞ্জ ফ্যানোর সুপরিচিত ‘ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্কস’-এর তত্ত্বকে, বডি হররের মাধ্যমে। কালোমানুষ সেখানে সাদা চামড়ার মানুষকে খুন করে তার চামড়া ছাড়িয়ে নিয়ে পরে নেয়। সেই ছবি পরিবেশিত হয়েছিল এক আন্তর্জাতিক ওটিটি মঞ্চের হ্যালোউইন সিরিজ়ের অঙ্গ হিসাবে। নুহাশই ছিলেন সম্ভবত উপমহাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি। সে দিক থেকে দেখলে, নুহাশ ‘পর্দা সরিয়েছেন’ অনেক আগেই। ‘দুই ষ’ সেই ‘পর্দা সরানো’র পরবর্তী পর্ব। কোনও বীভৎস দৃশ্যের অবতারণা না ঘটিয়ে, উচাটন করা লোকসুরকে ব্যবহার করে নুহাশ যে চিত্রভাষাটি নির্মাণ করছেন, তা ইতিপূর্বে কেউ করেছেন বলে মনে হয় না।

Review of the web series Dui Shaw by Nuhash Humayun

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।


‘ভাগ্য ভালো’ ছবিতে জ্যোতিষীর ভূমিকায় রয়েছেন মোশারফ করিম। তাঁর বিষয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তিনি একের পর এক বিস্ময় সৃষ্টি করে চলেছেন, নিজেকেই নিজে অতিক্রম করে যাচ্ছেন বার বার।

‘অন্তরা’য় আদি মানবীর ভূমিকায় জয়া আহসানকে ছাড়া আর কাকেই বা ভাবা যেত? কাস্টিংয়ের ব্যাপারেও নুহাশের তারিফ না করে পারা যায় না। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার বোধ হয় ইবলিশের ভূমিকায় আফজল হোসেন। আফজল এই সিরিজ়ে অপ্রতিরোধ্য। ‘অন্তরা’য় চঞ্চল চৌধুরীও রয়েছেন বিশেষ ভূমিকায়। বাকি অভিনেতারাও স্তম্ভিত করে রাখেন গোটা সিরিজ় জুড়ে।

অন্তিমে একটি বিষয় না বললেই নয়। ‘শ’ এবং ‘ষ’ নিয়ে যে খেলায় নুহাশ নেমেছেন, তার অন্ত কোথায়? শুধু ‘ইবলিশ’ আর ‘মানুষ’-এই নয়, ‘শ’ আর ‘ষ’ রয়েছে ‘শোষণ’ আর ‘শুষে নেওয়া’র মধ্যেও। এই ছবিগুচ্ছ কোনও না কোনও ভাবে সেই শোষণ বা শুষে নেওয়ার কথাও বলে। কখনও তা ভাগ্য, কখনও স্মৃতি। এর শেষ কোথায়?

লক্ষণীয়, ‘শেষ’ শব্দটিও গড়া হয়েছে ‘শ’ আর ‘ষ’ দিয়েই। ‘অন্তরা’য় আদি মানবী যখন ভটভটি গাড়িতে চড়ে অনন্তের পথে যাত্রা করে, তখন ‘শেষ’ শব্দটিও যেন তার সমস্ত মহিমা হারিয়ে ঝরে যায়। অন্তহীন ভাগ্য বিপর্যয় আর স্মৃতিবিভ্রমের এই উপমহাদেশে ‘শ’ আর ‘ষ’-এর দ্বন্দ্বকেও নিঃসীম মনে হয়। আতঙ্ক জাগে এর পর নুহাশ নিজে কোন দিকে হাঁটবেন?

Advertisement
আরও পড়ুন