(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় ও রাহুল গান্ধী।(ডান দিকে) সৌগত রায়। — ফাইল চিত্র।
শিমলায় বিজেপি বিরোধী দলগুলির পরবর্তী বৈঠক হতে পারে ১২ জুলাই। তার আগেই কংগ্রেসের উপর ‘চাপ’ তৈরি করা শুরু করে দিল তৃণমূল। বিজেপিকে হারাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাতলে-দেওয়া ‘জোটতত্ত্বের’ (যে দল যেখানে ‘শক্তিশালী’, সেখানে তাকে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ, বাংলায় আসনরফা বা সমঝোতা বা জোটের ক্ষেত্রে শেষ কথা বলবে তৃণমূলই) কথা জানিয়ে এবং লোকসভা-বিধানসভায় প্রাপ্ত আসনের পরিসংখ্যান দিয়ে তৃণমূল বোঝাতে শুরু করল, জাতীয় রাজনীতিতে জোট বা ঐক্য— যা-ই হোক না কেন, পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এবং কংগ্রেসকে একটিও আসন না-ছাড়া হতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের উত্থান কংগ্রেসের পতনের বিনিময়েই। ফলে এটা স্বাভাবিক যে, মমতা চাইবেন না, তাঁর মূল্যে কংগ্রেস বা সিপিএমের উত্থান হোক। গত দু’টি বিধানসভা ভোটে তৃণমূল বাংলায় একাই লড়েছে এবং মমতার নেতৃত্বে তাদের আসনসংখ্যা বেড়েছে। স্বভাবতই মমতা চাইবেন না, তৃণমূলের সেই ‘আধিপত্য’ কোনও ভাবে খর্ব হোক। ঠিক সেই কথাটাই রবিবার বলেছেন দলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায়। তাঁর কথায়, ‘‘পশ্চিমবাংলায় সিপিএমের কোনও আসন নেই। সেটা মনে রাখতে হবে। গত লোকসভায় কংগ্রেসের মাত্র দু’টো আসন ছিল। সেই সব মনে রেখে আসনভাগ হবে। আমরাই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে সারা ভারতবর্ষে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ লড়াইয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেব।’’ সোমবার আনন্দবাজার অনলাইনকে দমদমের তৃণমূল সাংসদ তাঁর মন্তব্যের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘‘২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বাংলা থেকে কংগ্রেস মাত্র দু’টি আসনে জিতেছিল। সিপিএম একটিতেও জেতেনি। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে দু’টি দলই শূন্য। আমি বোঝাতে চেয়েছি, ওই হিসেব মাথায় রাখলে আপাতদৃষ্টিতে এ রাজ্যে আগামী লোকসভা ভোটে কংগ্রেস এবং সিপিএমের একটিও আসনে লড়ার কথা নয়।’’
গত শুক্রবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের ডাকে পটনায় বিরোধী নেতাদের বৈঠকে বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত হয়। সেখানেই ঠিক হয়, জোটের পরের বৈঠকটি হবে কংগ্রেস শাসিত শিমলায়। তার মধ্যেই সৌগতের এই মন্তব্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
বিরোধী দলগুলির বৈঠকে তৃণমূল ছাড়াও আরও ১৪টি রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতৃত্ব হাজির ছিলেন। তাঁরা সকলেই কার্যত মমতার সুরে বিজেপিকে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ প্রার্থীর তত্ত্বে সায় দিয়েছেন বলে দাবি করেন সৌগত। রবিবার তৃণমূলের এক সভায় তিনি বলেন, ‘‘১৪টা দল একবাক্যে বলল, মোদীকে সরাতে চাই। এটা একটা বড় অ্যাচিভমেন্ট (প্রাপ্তি)। এর মধ্যে আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় অবদান আছে। উনি বলেছেন, অতীতে কী হয়েছে সব ভুলে যান। বিজেপিকে সরতে হবে। কারণ, ওদের পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। আমরা চাই ‘ওয়ান ইজ টু ওয়ান’ হোক।’’
প্রসঙ্গত, এর আগে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে কংগ্রেস-তৃণমূলের সমঝোতা হয়েছিল। সে সময় ঐক্যবদ্ধ ভাবে সিপিএমের মোকাবিলার উদ্দেশ্যে সনিয়া গান্ধীর দলকে ১৪টি আসন ছেড়েছিলেন মমতা। এসইউসিকে ছেড়েছিলেন একটি। এর পর গত দেড় দশকে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমূল বদলে গিয়েছে। প্রধান বিরোধী দল হিসাবে উঠে এসেছে বিজেপি। অন্য দিকে, ২০১১-র বিধানসভা ভোট পর্যন্ত মমতার সহযোগী কংগ্রেস গত দু’টি বিধানসভা ভোটে (২০১৬ এবং ২০২১) সিপিএম তথা বামেদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়েছে।
শনিবার পটনায় মমতা বলেছিলেন ‘‘আমরা একজোট। আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করব।’’ বিজেপিকে রুখতে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ লড়াইয়ের পক্ষেও সওয়াল করেছিলেন তিনি। তবে সুনির্দিষ্ট ভাবে বিরোধী দলগুলির আসন সমঝোতা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও ‘সূত্রের’ কথা বলেননি।
সেখানে আগামী লোকসভা ভোটে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে মমতার পাশাপাশি সওয়াল করেছিলে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও। বৈঠকের পরে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে মমতার ঠিক আগে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মধ্যে ছোটখাটো মতপার্থক্য হবে। কিন্তু আমাদের নমনীয় হয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কারণ, আমরা একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
কংগ্রেসের অনেকেরই মতে, রাহুল আদতে মমতাকেই ‘নমনীয়’ হওয়ার বার্তা দিয়েছিলেন। কিন্তু তেমন কোনও মনোভাব অন্তত সৌগতের বক্তব্যে মেলেনি। জোট হলে আসন সমঝোতা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে যে টানাপড়েন কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, সোমবার সৌগতের বক্তব্যে তা স্পষ্ট।
ঘটনাচক্রে, শনিবার পটনার বৈঠকে যে দলগুলির নেতারা হাজির ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই স্ব স্ব রাজ্যে কংগ্রেসের সহযোগী। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ এবং উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদবের আরজেডি রয়েছে সেই তালিকায়। রয়েছে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের জেএমএম, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিনের ডিএমকে। নীতীশের বৈঠকে হাজির উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা (বালাসাহেব) এবং শরদ পওয়ারের এনসিপির সঙ্গেও মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসের জোট রয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা এবং মেহবুবা মুফতির দল ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং পিডিপি-ও সে রাজ্যে ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ ভাবে আন্দোলনে শামিল।
পটনার বৈঠকে হাজির তিন বাম দলের মধ্যে সিপিএম এবং সিপিআই বিহার, তামিলনাড়ু-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিজেপি বিরোধী যে জোটে রয়েছে, সে জোটে কংগ্রেসও রয়েছে। বাংলা এবং ত্রিপুরায় সিপিএম-সিপিআইয়ের সঙ্গে কংগ্রেসের আসন সমঝোতার নজির রয়েছে। আবার দক্ষিণ ভারতের কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে দুই বাম দলের মূল লড়াই। দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সিপিআইএমএল-লিবারেশন বিহারে জেডিইউ, আরজেডি, কংগ্রেসের সঙ্গে ‘মহাগঠবন্ধন’-এ রয়েছে।
সেদিক থেকে দেখতে গেলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিতে লোকসভা ভোটে আসন সমঝোতার ক্ষেত্র প্রস্তুত রয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন। কিন্তু তৃণমূলের পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি (এসপি) এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আম আদমি পার্টি (আপ)-এর সঙ্গে কংগ্রেসের কোনও বোঝাপড়া নেই। বস্তুত, কংগ্রেসের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেই দিল্লি এবং পঞ্জাবে শাসক হয়েছে আপ। উল্লেখ্য, পটনার বৈঠকের আগে অখিলেশও মমতার সুরেই কংগ্রেসের উপর চাপ বাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে হারাতে বড় জাতীয় দলের সমর্থন চাই।’’ ঘটনাচক্রে, জাতীয় রাজনীতিতে এসপি এবং আপের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত তৃণমূলের সম্পর্ক ‘ঘনিষ্ঠ’। কিন্তু রাজ্যে তৃণমূলের ‘বাধ্যবাধকতা’ রয়েছে। সে দিকে লক্ষ্য রেখেই তৃণমূল শিমলার বৈঠকের আগে কৌশলী ভাবে নিজেদের বক্তব্য জানিয়ে ‘চাপ’ বাড়াতে শুরু করে দিল।