২০২২ সালে অভিষেক পাঁচটি সভা করেছেন। পাঁচটি সভায় তিনি যা বলেছেন এবং প্রশাসনে তার যা অভিঘাত হয়েছে, সেগুলি প্রণিধানযোগ্য। ছবি: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক পাতা থেকে।
তিনি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। তিনি দলের সাংসদও বটে। কিন্তু ধীরে হলেও নিশ্চিত ভাবেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য সরকারেও ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা পালন শুরু করেছেন।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের বিপুল জয়ের পর অভিষেককে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়ে এসেছিলেন দলের সর্বময় কর্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর থেকেই অভিষেক দলের হাল ধরতে উদ্যোগী হন। বিজেপি থেকে দলে কাদের নেওয়া হবে, কাদের হবে না, সে বিষয়ে তখন থেকেই তাঁর মতামত গুরুত্ব পেতে শুরু করেছিল। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে অভিষেক সরকারেও ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছেন। যদিও প্রত্যক্ষ ভাবে নয়। কারণ, অভিষেক মনে করেন, দল এবং সরকার আলাদাই থাকবে। কিন্তু দলের পাশাপাশি সরকারেও যে তাঁর পদধ্বনি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে, গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে এখনও পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহে তা স্পষ্ট।
২০২২ সালের মে মাস থেকে সম্প্রতি অভিষেক যে ক’টি সভা করেছেন, তার প্রত্যেকটিতেই তিনি যেমন নানা সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন, তেমনই সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাঁর পছন্দ-অপছন্দের কথা জানিয়েছেন। সেই সভায় অভিষেক সরকারি প্রকল্প নিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। যার পরে কখনও মন্ত্রী, কখনও সচিবদের তৎপর হতে দেখা গিয়েছে। আবার বিভিন্ন এলাকায় ‘অযোগ্য’ জনপ্রতিনিধিদের ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছেন। দ্বিতীয় পদক্ষেপটি নিয়ে বিরোধীরা অভিযোগ তোলা শুরু করেছে। তাদের বক্তব্য, অভিষেক সরকারের অঙ্গ নন। তিনি দলের নেতা। তিনি কী করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেন! বিরোধীদের অনেকে তাঁর মধ্যে সঞ্জয় গান্ধীর ছায়াও দেখতে পাচ্ছেন। পক্ষান্তরে, অভিষেকের ঘনিষ্ঠেরা জানাচ্ছেন, দলের টিকিটে ভোটে জিতে যদি কেউ কাজ না করেন, তা হলে তাঁকে তাঁর পদ থেকে ইস্তফা দিতে বলার অধিকার দলনেতার রয়েছে। আর সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে তুলনাকে তাঁরা ‘রজ্জুতে সর্পভ্রম’ বলেই ব্যাখ্যা করতে চান।
তবে যিনি যে ভাবেই ব্যাখ্যা করুন, এটা অনস্বীকার্য যে, দলের গণ্ডি ছাড়িয়ে সরকারে এবং প্রশাসনে অভিষেকের ‘গুরুত্ব’ ক্রমশ বাড়ছে। ২০২২ সালে অভিষেক পাঁচটি সভা করেছেন। সেগুলি ছাড়া আসানসোল লোকসভা, বালিগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচন এবং কলকাতার পুরভোটের প্রচার মিলিয়ে তিনটি রোড শো বা সভা করেছেন। কিন্তু শেষোক্ত তিনটি বাদ দিলে বাকি পাঁচটি সভায় অভিষেক যা বলেছেন এবং প্রশাসনে তার যা অভিঘাত হয়েছে, সেগুলি প্রণিধানযোগ্য।
২০২২ সালে অভিষেক প্রথম সভা করেন পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়ায়। ২৮ মের সেই সভা থেকে তিনি বন্দর শহরে শ্রমিকদের সমস্যা ও বেতনবৃদ্ধির দাবি নিয়ে একটি কমিটি গঠনের কথা বলেন। জেলাশাসক ও শ্রম দফতরকে নিয়ে সেই যৌথ কমিটি হবে বলে সভাতেই জানিয়েছিলেন অভিষেক। দ্রুত সেই উদ্যোগও শুরু হয়ে যায়।
২০২২ সালে অভিষেকের দ্বিতীয় সভা ছিল ১২ জুলাই। উত্তরবঙ্গের ধূপগুড়িতে। সেখানেই তাঁর মুখে প্রথম ‘নতুন তৃণমূল’ শব্দবন্ধ শোনা যায়। যা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে অনেক জল্পনার জন্ম নিয়েছিল। পরে ধাপে ধাপে অভিষেক বুঝিয়ে দেন, ‘নতুন তৃণমূল’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। ধূপগুড়ির সভায় ওই ‘রাজনৈতিক’ বক্তব্য ছাড়াও ওই সভা থেকে অভিষেক সেচ এবং বন দফতরের কাজের মতো ‘প্রশাসনিক’ বিষয় নিয়েও সরব হন। তিনি জানান, উত্তরবঙ্গ ১২-১৪টি নদনদী দিয়ে ঘেরা। কিন্তু তা সত্বেও বর্ষাকাল ছাড়া ওই এলাকায় চাষের কাজ হয় না। কারণ, পর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থার অভাব। ওই সভার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সেচমন্ত্রী পার্থ ভৌমিক উত্তরবঙ্গে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছিলেন।
উত্তরবঙ্গেই ছিল অভিষেকের তৃতীয় সমাবেশ। ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জলপাইগুড়ির মালবাজারে আইএনটিটিইউসি-র চা শ্রমিকদের কর্মিসভায় যোগ দিয়ে দু’টি ঘোষণা করেছিলেন অভিষেক। এক, চা বাগান সংলগ্ন এলাকাতেই হবে চা শ্রমিকদের সন্তানদের রাখার ‘ক্রেশ’। সব চা শ্রমিককে দেওয়া হবে পরিচয়পত্র। মঞ্চে ছিলেন রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক। তাঁর উদ্দেশে অভিষেক বলেন, ‘‘আমি শ্রমমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, প্রত্যেক চা শ্রমিকের জন্য যাতে পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়।’’ অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি কাজের জন্য শ্রম দফতরকে তিন মাস সময়ও বেঁধে দেন অভিষেক। সেই কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে বলে পরে জানান মন্ত্রী। ওই সভা থেকেই চা শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল তৈরি কথা বলেছিলেন অভিষেক। সম্প্রতি আলিপুরদুয়ারে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে সে ঘোষণা করে দিয়েছেন।
অভিষেকের চতুর্থ সভা ছিল কাঁথিতে। ৩ ডিসেম্বর। স্থানমাহাত্ম্যের কারণে সেই সভার ‘রাজনৈতিক গুরুত্ব’ অনেক বেশি ছিল। কিন্তু বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর শহরে গিয়ে তাঁকে রাজনৈতিক আক্রমণ করার পাশাপাশি মৎস্য দফতর ও বিদ্যুৎ দফতরের কাজকর্ম নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অভিষেক। কী কী করতে হবে, তা-ও বলেন। এর পরেই বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘা যাওয়া-আসার রাস্তায় বিদ্যুৎ সংক্রান্ত সমস্যা মেটাতে তৎপর হন বিদ্যুৎমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস।
অভিষেকের পঞ্চম সভা ছিল নদিয়া জেলার রানাঘাটে। গত ১৭ ডিসেম্বর। ফলাফলের নিরিখে নদিয়া জেলা তৃণমূলের কাছে খুব ‘স্বস্তি’র নয়। ফলে নদিয়ার রানাঘাটের সেই সভাতেও অভিষেক দলীয় সংগঠনের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আগে যাঁরা আসতেন, তাঁরা সব কিছু ঠিকঠাক করেননি। কারও নাম করেননি। কিন্তু তৃণমূলের অন্দরে সকলেই জানেন, নদিয়া জেলার প্রথম ‘পর্যবেক্ষক’ ছিলেন মুকুল রায়। তার পরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়। মন দিয়ে যাঁরা অভিষেকের রানাঘাটের বক্তৃতা শুনেছেন, তাঁরা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন, নাম না-করে মুকুল-পার্থকেই কটাক্ষ করেছিলেন অভিষেক।
আবার তারই পাশাপাশি তাঁত শ্রমিকদের সমবায়কে বাড়তি উদ্যোগ নেওয়ার ‘প্রশাসনিক’ পরামর্শও দিয়েছিলেন অভিষেক। ঘটনাচক্রে, তার দু’সপ্তাহ পর সমবায় দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি বদলে দেয় নবান্ন। গত ১৬ জানুয়ারি ওই পদে এসেছেন পিবি সেলিম। দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রাক্তন জেলাশাসক সেলিম অভিষেকের ‘আস্থাভাজন’ বলেই প্রশাসনিক মহলের একাংশের দাবি। যদিও সরকারি সূত্রে বা আনুষ্ঠানিক ভাবে এর কোনও সমর্থন মেলেনি।
বাম আমলেও অনেক সিদ্ধান্ত আলিমুদ্দিন স্ট্রিট নিয়ে নেওয়ার পরে তা কার্যকর করত সরকার ও প্রশাসন। তবে সেই নির্দেশ আলিমুদ্দিন আড়াল থেকেই দিত। অভিষেক প্রকাশ্য জনসভার মঞ্চ থেকে ইস্তফা দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। তবে তৃণমূল বিধায়ক তথা দলের মুখপাত্র তাপস রায়ের কথায়, ‘‘সরকারটা তৃণমূলের। অভিষেক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। আমরা যাঁরা দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাঁরা তো দলের মনোনয়নেই নির্বাচিত। দলের দুই প্রতীক জোড়াফুল আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ সামনে রেখেই জিতেছি। সেই দলের নেতা হিসাবে অভিষেক যা করছেন, তা সম্পূর্ণ ঠিক।’’
বিরোধীরা অবশ্য সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পাশাপাশি আরও নজির টেনে দাবি করছেন, অভিষেকই এখন সরকারের ‘নিয়ন্ত্রক’। যার অন্যতম উদাহরণ বিক্ষুব্ধ চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ে ক্যামাক স্ট্রিটের দফতরে অভিষেকের বৈঠক। ২০২২ সালের জুলাই মাসের সেই বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও উপস্থিত ছিলেন। তবে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘মন্ত্রী’ নয়, দলের নেতা হিসাবেই ছিল তিনি বৈঠকে ছিলেন। কিন্তু সেই বৈঠকের উদাহরণ টেনেই সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম দাবি করছেন, ‘‘এখন সরকারি সিদ্ধান্ত নবান্নের তুলনায় বেশি হয় অভিষেকের ক্যামাক স্ট্রিটের কর্পোরেট অফিস থেকে। এটাকে বলে এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল অথরিটি। সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতা। তৃণমূল চালাচ্ছে পুলিশ-প্রশাসন আর সরকার চালাচ্ছেন অভিষেক। প্রশাসনিক কর্তারাও তাঁকেই রিপোর্ট করেন। এমনটা জরুরি অবস্থার সময়ে সঞ্জয় গান্ধীর মধ্যেও দেখা গিয়েছিল।’’
রাজ্য বিজেপি ‘সঞ্জয় গান্ধী’ বলতে চায় না। তবে এতটা না বললেও সরকারি সিদ্ধান্তে যে অভিষেকের ‘দাপট’ ক্রমশ বাড়ছে, সে পর্যবেক্ষণ তাদেরও রয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর ডায়মন্ড হারবারের রবীন্দ্র ভবনে প্রশাসনিক বৈঠক ডেকেছিলেন অভিষেক। এক জন সাংসদ রাজ্য প্রশাসনকে নিয়ে এমন বৈঠক করতে পারেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিজেপি। ওই সব উদাহরণ টেনে রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলছেন, ‘‘দলের নেতা দল চালাবেন। কিন্তু সরকার চালাবেন কেন? তৃণমূলের কাছে এটা অবশ্য কোনও অনিয়ম নয়। পারিবারিক দল দ্বিতীয় প্রজন্মের কর্তা তৈরি করছে। কে থাকবেন, কে থাকবেন না সেটা উনিই ঠিক করছেন। বিষয়টা তৃণমূলের। তাই কিছু বলার নেই। কিন্তু এটাই পরিবারতন্ত্রের লক্ষণ। দেশে অন্য অনেক দলেই সেটা দেখা গিয়েছে। তারা সবাই শেষও হয়ে গিয়েছে। এই রাজ্যেও আমাদের অন্যতম লড়াই এই পরিবারতন্ত্রকে উৎখাত করা।’’
এর পাল্টা যুক্তি তৈরি রেখেছে তৃণমূল। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষের কথায়, ‘‘শাসকদলের কাজ সরকার এবং প্রশাসনকে সহায়তা করা। সেই কাজটাই অভিষেক যোগ্য নেতা হিসাবে করছেন। কোনও জায়গায় দল যদি মনে করে, কোনও ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি হিসাবে কাজ করতে পারছেন না এবং তার জন্য সরকারি কর্মসূচি রূপায়ণে অসুবিধা হচ্ছে, তবে দলের তরফে রদবদল হতেই পারে।’’ পাশাপাশিই কুণালের সংযোজন, ‘‘দলের সুনাম বাড়াতে এবং সরকারের কাজ যাতে ভাল ভাবে হয়, সেটা নিশ্চিত করতে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তাতে তো আপত্তির কিছু নেই। দলের নেতা হিসাবে বরং সেটা অত্যন্ত ইতিবাচক!’’