তাপস মণ্ডলের ডায়েরির কয়েকটি পৃষ্ঠা আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে। নিজস্ব ছবি।
তাপস মণ্ডলের ডায়েরি। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় রবিবার গ্রেফতার হয়ে সোমবার সিবিআই হেফাজতে যাওয়া তাপসের যে ডায়েরি উদ্ধার করেছিল এনফোর্সটমেন্ট (ইডি), তার ছত্রে ছত্রে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের অঙ্ক। ছত্রে ছত্রে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একের পর এক নাম। রয়েছে নানান জায়গারও উল্লেখ। বেহালা থেকে পাঁশকুড়া, ‘হাই কোর্ট’ থেকে ‘আরবানা’। আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে আসা সেই ডায়েরির পাতায় ভরা এই সব ব্যক্তিনাম আর স্থানরহস্যই এখন সমাধান করতে চাইছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।
এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর একটি সূত্রের দাবি, ডায়েরিতে যা লেখা রয়েছে, তা নিশ্চিত ভাবে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাপস কার সঙ্গে, কবে, কোথায় টাকার লেনদেন করেছেন, তারই হিসাবনিকাশ রয়েছে এতে। সব চেয়ে বেশি বার লেখা হয়েছে ‘কুন্তল ঘোষ’ নাম। তবে কোথাও বিশদে কিছু বলা নেই। ডায়েরির পাতায় ‘নোট’ লিখে রাখার মতো। আর রয়েছে কিছু সই। সেই সব হস্তাক্ষরের সত্যতা অবশ্য আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি।
নিয়োগে অনিয়মের মামলায় গত বছর অক্টোবরে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক গ্রেফতার হওয়ার পরেই তাপসের নাম উঠে আসে। তখন থেকেই তাপস দাবি করে এসেছেন, নাকাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক মানিক লোক পাঠিয়ে তাঁর কাছ থেকে অনলাইন-অফলাইনে পড়ুয়া ভর্তি, বেসরকারি কলেজের অনুমোদন বাবদ টাকা নিয়ে যেতেন। বহ যুবক-যুবতীকে বেআইনি ভাবে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য তৃণমূলের যুব নেতা কুন্তল ঘোষকেও কোটি কোটি টাকা দিয়েছেন তিনি। তাঁর ডায়েরিতেই সেই সবের উল্লেখ রয়েছে। তাপস দাবি করেছেন, কুন্তল সই করেই সেই টাকা নিয়েছেন। যদিও তাপসের তোলা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। তবে পরে কুন্তল গ্রেফতার হন এই নিয়োগ মামলাতেই।
আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে আসা ওই ডায়েরিতে যেমন ২০১৭ সালের লেনদেনের হিসাব রয়েছে, তেমনই রয়েছে ২০২১ সালের তথ্যও। একটি পাতায় ‘প্রাইমারি’ শিরোনামের ‘এন্ট্রি’তেই যেমন দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত লেনদেনের হিসাব রয়েছে। গোটা পাতা জুড়ে রয়েছে কুন্তলের নাম। সেই সঙ্গেই রয়েছে ‘হাই কোর্ট’-এর উল্লেখ। মাঝে ইডি সূত্রে দাবি করা হয়, আদালতে মামলার জন্যও ১,২০০ চাকরিপ্রার্থীর থেকে ২০ হাজার করে প্রায় ২.৪ কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কুন্তলের বিরুদ্ধে। ডায়েরির সেই পাতাতেই ‘বেহালা পিএস’ শব্দবন্ধ লেখা রয়েছে। তদন্তকারীদের একাংশের ধারণা, ‘বেহালা পিএস’ মানে বেহালা থানা এলাকার কথাই বলা হচ্ছে হয়তো। ঘটনাচক্রে, নিয়োগ মামলায় গ্রেফতার হওয়া রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বেহালা পশ্চিমের বিধায়ক। আরও একটি পাতায় ‘প্রাইমারি’ শিরোনামের ‘এন্ট্রি’তে রয়েছে ৩ কোটি ৮২ লক্ষ টাকার উল্লেখ।
২০১৯ সালের ২৯ মার্চের এন্ট্রিতে আবার ‘আপার প্রাইমারি’ (উচ্চ প্রাথমিক)-র হিসাবনিকাশ রয়েছে। লেখা হয়েছে, ‘‘এই তারিখ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৪৭ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা পেমেন্ট করা হয়েছে।’’ তার পাশেই রয়েছে কুন্তলের নাম। ওই পাতায় ২০১৯ সালের বিভিন্ন তারিখ, একাধিক ব্যক্তি ও জায়গার নাম রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে টাকার অঙ্ক। যেমন, ৫ লক্ষ টাকার পাশে লেখা ‘অফিস-গৌতম’। একই ভাবে, দু’জায়গায় ‘আরবানা’র পাশে দেড় লক্ষ ও ৫ লক্ষ টাকার হিসাব। প্রসঙ্গত, কলকাতা শহরে ‘আরবানা’ নামের আবাসন রয়েছে। তার সঙ্গে কোনও যোগ রয়েছে কি না, তা যদিও স্পষ্ট নয়। রয়েছে তাপস মিশ্রের নাম। নিয়োগ মামলায় এই তাপসের নামও উঠেছে। ইডি সূত্রে দাবি, এই তাপসকে তলবও করা হয়েছে। তবে সাড়া মেলেনি। তাঁর হদিসও মিলছে না।
ডায়েরির একটি পাতায় লেখা, ‘‘৯.৯.১৮ থেকে ১০.২.১৯-এর মধ্যে তাপসকুমার মণ্ডলের থেকে ১০ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা পেয়েছি।’’ তার নীচে একটি সই রয়েছে। ইডির ওই সূত্রটির দাবি, সেটি কুন্তলের সংক্ষিপ্ত সই (ইনিশিয়াল সিগনেচার)। কুন্তল যে টাকা পেয়েছেন, তা বোঝানোর জন্যই নীচে সই করা হয়েছে। তবে ডায়েরির ওই পাতায় উল্লিখিত সালের মধ্যে কোনও সামঞ্জস্য নেই। কোথাও ২০১৯ সালের হিসাব, কোথাও আবার ২০১৮ সালের। সেখান থেকে প্রশ্ন উঠছে, তা হলে এগুলি কবে লেখা হয়েছে? তা ছাড়া, এক জায়গায় কুন্তলের পুরো নাম, অন্য একটি জায়গায় কেন সংক্ষিপ্ত সই রয়েছে, উঠছে সেই প্রশ্নও।
২০১৭ সালের হিসাব সংক্রান্ত যে নথি হাতে এসেছে, তাতে প্রচুর জায়গার নাম এবং বেশ কয়েক জন ব্যক্তির উল্লেখ রয়েছে। জায়গার তালিকায় মহিষবাথান, সিটি সেন্টার, কৈখালি, অন্য দিকে রয়েছে এ রায় বর্মণ, গোপাল’দা, বুবাই, উমাপদের মতো নামের উল্লেখ। শেষে রয়েছে ৩ কোটি ২৫ লক্ষ টাকার হিসাব। এর আগে ইডির একটি সূত্র দাবি করেছিল, জেরায় তাপস অভিযোগ করেছিলেন, ৩২৫ জন শিক্ষক পদপ্রার্থীর কাছে থেকে ৩ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা নিয়েছেন কুন্তল। তৃণমূল নেতা কুন্তল যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তবে এই ডায়েরিতে যে সই রয়েছে, তা কার? তাপসের দাবি মতো তা কুন্তলের, না কি অন্য কারও? তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। তা হলে কি ওই ডায়েরি হস্তরেখা বিশারদ এবং ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠাবেন তদন্তকারী? তা হলে সেখান থেকে হয়তো জানা যাবে, কে ঠিক বলছেন! তাপস না কি কুন্তল!