Sandeshkhali Incident

তৃণমূল শাসনের ১৩ বছরে সন্দেশখালি ‘নজিরবিহীন’, গণসংগঠনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন শাসকদলের অন্দরেই

সন্দেশখালি নিয়ে শাসকদলের মধ্যে খানিকটা আশঙ্কা রয়েছে। ঘরোয়া আলোচনায় সে কথা মানছেন নেতাদের একাংশ। লোকসভা ভোটের আগে এই ‘রাজনৈতিক ক্ষতে’ প্রলেপ পড়বে কি না, তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:০০
Sandeshkhali incidengt is unprecedented in TMC\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\'s 13-year rule

গণক্ষোভের আঁচ কেন আগাম পেল না দল, প্রশ্ন তৃণমূলেই। —গ্রাফিক সনৎ সিংহ।

১৩ বছর। এক যুগেরও বেশি পার। বাংলায় তৃণমূলের এই ১৩ বছরের শাসনে বিবিধ ঘটনা ঘটেছে। আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু শাসকদলের নেতারাও ঘনিষ্ঠ এবং একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, সন্দেশখালি সব দিক থেকেই ‘নজিরবিহীন’। যা দলের জন্য দুশ্চিন্তার এবং উদ্বেগের।

Advertisement

এই ১৩ বছরে যে যে ঘটনায় তৃণমূলকে ‘বেগ’ পেতে হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম বীরভূমের বগটুই। কারণ, রামপুরহাটের ওই গ্রামে একটি খুনের পাল্টা রাতের অন্ধকারে লাইন দিয়ে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ভাঙড়ের কাশীপুর থানার নতুনহাট এলাকা পাওয়ার গ্রিড বিরোধী জমি আন্দোলন ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। জমি আন্দোলনে মৃত্যু হয়েছিল আলমগির মোল্লা এবং মফিজুল খানের। তফাত একটাই— বগটুই এবং ভাঙড়— দু’জায়গাতেই শবদেহ ছিল। সন্দেশখালিতে তা নেই। কিন্তু আন্দোলন রয়েছে।

রাজনীতির কারবারিরা বিলক্ষণ জানেন, যে কোনও আন্দোলনে ‘মৃত্যু’ ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তার উদাহরণ নন্দীগ্রাম। মৃত্যু আন্দোলনকে দীর্ঘমেয়াদি করে। কিন্তু মৃত্যুহীন সন্দেশখালিতে প্রতি দিন যে ভাবে নতুন নতুন অভিযোগ উঠছে, তাতে শাসকদলের মধ্যেও আশঙ্কার মেঘ জমছে।

তৃণমূলের অন্দরে প্রশ্ন, স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ, মহিলাদের এই রণমূর্তি, তা দলের গোচরে এল না কেন? শাসকদলের এক নেতার জবাব, ‘‘গণসংগঠনের যে ভূমিকা থাকা উচিত, তা ছিল না। দলের কর্মসূচির যে রিপোর্ট রাজ্য স্তরে পৌঁছত, তা-ও জল মেশানো। এখন সবটা বোঝা যাচ্ছে।’’ সার্বিক ভাবে ব্লক স্তরের সংগঠন, তাতে জেলা স্তরের নজরদারি এবং রাজ্য নেতৃত্বের পর্যবেক্ষণ। এই তিনটি স্তরে রাজনৈতিক দলের সংগঠন কাজ করে। সন্দেশখালিতে সেই গোটা সাংগঠনিক প্রক্রিয়াই ভেঙে পড়েছিল বলে অভিমত নেতাদের একাংশের।

লোকসভা ভোটের আগে দলকে স্লোগান বেঁধে দিয়েছেন ‘তৃণমূলের সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর স্লোগান— ‘জমিদারি হটাও, বাংলা বাঁচাও!’ অভিষেক বিজেপির বিরুদ্ধে দখলদারির মানসিকতার অভিযোগ তুলে ‘জমিদারি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যা তিনি করেছিলেন গত অক্টোবরের আন্দোলনেও। কিন্তু সন্দেশখালিতে প্রতি দিন যা যা প্রকাশ্যে আসছে, তা কি অভিষেকের স্লোগানের পরিপন্থী নয়? তৃণমূলের এক বিধায়কের কথায়, ‘‘যা অভিযোগ জানা যাচ্ছে, তার চার আনাও যদি সত্যি হয়, তা হলে বুঝতে হবে তৃণমূলের ঝান্ডাকে সামনে রেখে শাহজাহান শেখ, শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারেরা সন্দেশখালিতে তাঁদের জমিদারিই কায়েম করেছিলেন।’’

বস্তুত, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বাংলায় ধাক্কা খাওয়ার পর তৃণমূল পেশাদার সংস্থাকে নিয়োগ করেছিল। তার পর সংগঠনের সঙ্গে মানুষের সমন্বয়ের জন্য ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়ে গিয়েছে শাসকদল। মানুষের ক্ষোভের বাষ্প যাতে বেরিয়ে যায়, সেই ক্ষোভ যাতে ভোটে প্রতিফলিত না হয়, তার জন্য ‘দিদির দূত’ কর্মসূচিতে এলাকায় এলাকায় নেতাদের রাত্রিবাসের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। সন্দেশখালিতে তা কতটা হয়েছে, তা নিয়ে এখন সন্দিহান দল। ‘হয়েছে’ বলে রিপোর্ট এসেছিল। কিন্তু তার সঙ্গে যে সত্যের দূরত্ব ছিল, তা এখন ময়নাতদন্তে বসে মেনে নিচ্ছেন নেতারাও। শাসকদলের নেতারা আরও একটি বিষয় নিয়ে চিন্তিত— মহিলাদের উপর অত্যাচারের যে অভিযোগ উঠছে, তাতে সত্য-মিথ্যা প্রমাণের আগেও ‘ধারণার প্রশ্ন’ বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘দিদির ভোটের অন্যতম ভিত্তি মহিলা ভোট। সন্দেশখালির মহিলারা যা বলছেন, তাতে সল্টলেকের মহিলারা প্রভাবিত হলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।’’

সন্দেশখালির আন্দোলনের মেজাজ, মহিলাদের সামনে এগিয়ে আসা, পুলিশের সঙ্গে সংঘাত ইত্যাদি সূচককে অনেকেই নন্দীগ্রামের সঙ্গে তুলনা করতে চাইছেন। কেউ কেউ এমনও বলছেন, নন্দীগ্রামে যেমন লক্ষ্মণ শেঠের বিরুদ্ধে গণরোষ তৈরি হয়েছিল, তেমন সন্দেশখালির ‘লক্ষ্মণ শেঠ’ হলেন শাহজাহান। সেই আখ্যান তৈরি করার চেষ্টা করছে প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও। যদিও অভিজ্ঞদের অনেকের বক্তব্য, নন্দীগ্রামে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালের জানুয়ারির গোড়ায়। তার পর ১৪ মার্চ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। নন্দীগ্রামে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশ গোড়ায় ঢুকতেই পারেনি। গোটা নন্দীগ্রাম কার্যত ‘মুক্তাঞ্চল’ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সন্দেশখালি তা নয়। সেখানে পুলিশ যাচ্ছে, ডিজি যাচ্ছেন, মানুষের ক্ষোভ থাকলেও শাসকদলের নেতা-নেত্রীরাও ঢুকতে পারছেন। তবে অন্য অংশের বক্তব্য, নন্দীগ্রামের সঙ্গে সন্দেশখালির মৌলিক একটি মিল রয়েছে। তা হল জমি এবং রুটিরুজি।

নন্দীগ্রামে ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’ একটি সংগঠিত মঞ্চ ছিল। নেপথ্যে ছিল নানা রঙের রাজনীতি। সন্দেশখালিতে এখনও তেমন কোনও মঞ্চ নেই। তবে রাজনীতি আছে। যা সরকার এবং প্রতিষ্ঠানের বিরোধী। বাম জমানায় নন্দীগ্রাম এবং তৃণমূল জমানায় ভাঙড়ের আন্দোলনে নকশালপন্থীদেরও উপস্থিতি এবং অংশগ্রহণ ছিল। সন্দেশখালিতে এখনও তেমন কিছু জানা যায়নি। ফলে নদীঘেরা ন’টি দ্বীপাঞ্চলের আন্দোলন একেবারেই সেখানকার স্থানীয় মানুষের। তবে সেই আন্দোলনে ঘৃতাহূতি দিতে অনুঘটকের ভূমিকা রয়েছে বিরোধীদেরও।

বগটুই ছিল তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর কাঁচা টাকার রাজনীতির নিদারুণ ফল। সেখানে তিন দিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন। ভাঙড়ের পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়েছে ধীরে ধীরেই। সন্দেশখালিতেও মন্ত্রীদের পাঠিয়ে, পুলিশের ক্যাম্প করে বাসিন্দাদের অভিযোগ নিয়ে আস্থা তৈরির জোড়া কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও শাসকদলের মধ্যে এই আলোচনা রয়েছে যে, যে গভীর রাজনৈতিক ক্ষত তৈরি হচ্ছে তাতে লোকসভার আগে প্রলেপ পড়বে কি না!

যদিও শাসকদলের নেতৃত্বের একাংশ এমনও জোর দিয়ে বলছেন যে, তৃণমূল স্তরে ভোটে এর কোনও প্রভাবই পড়বে না। এক নেতার কথায়, ‘‘গোলমাল বা আন্দোলন হচ্ছে চার-পাঁচটা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। সেখানে ইচ্ছে করে গোলমাল জিইয়ে রাখা হচ্ছে। কিন্তু মানুষ টানা অশান্তি চান না। প্রশাসনও ব্যবস্থা নিচ্ছে। হয়তো আগে কোনও ভুল হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন তো তার সংশোধনও করছে।’’

আরও পড়ুন
Advertisement