দিল্লি গণধর্ষণ-কাণ্ডে নির্যাতিতার মা আশা সিংহ। —ফাইল চিত্র।
‘‘১০ বছর জেল খেটেই গণধর্ষণের মতো অপরাধের মেয়াদ শেষ হয়ে গেল! এর চেয়ে তো প্রথমেই মুক্তি দিয়ে দিলে পারত। ১০ বছর ধরে বিচারের আশায় থাকা পরিবারের এ ভাবে আশাভঙ্গ হত না।’’ কামদুনি গণধর্ষণ-কাণ্ডে রায় তার কিছুক্ষণ আগেই শুনিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। সেই রায়ের কথা শুনে ফোনে এ ভাবেই ক্ষোভে ফেটে পড়লেন দিল্লি গণধর্ষণ-কাণ্ডে নির্যাতিতার মা আশা সিংহ। বললেন, ‘‘সান্ত্বনা নয়, বড় লড়াই এখন ওঁদের সামনে। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাক ওঁরা। না-হলে কোনও দিন দেখা যাবে আমৃত্যু কারাবাসের সাজা পাওয়া অপরাধীও মুক্তি পেয়ে ঘুরে বেড়াবে।’’
২০১২ সালের ডিসেম্বরের এক শীতের রাতে জীবনটা আমূল বদলে গিয়েছিল দিল্লিনিবাসী আশা ও বদ্রীনাথ সিংহের, যখন জানতে পেরেছিলেন তাঁদের মেয়েকে চলন্ত বাসে গণধর্ষণ করা হয়েছে। কয়েক দিন পরে জীবনযুদ্ধে ‘নির্ভয়া’ হার মানলেও ন্যায়বিচার পেতে শেষ পর্যন্ত লড়ে গিয়েছেন সিংহ দম্পতি। অপরাধীদের ফাঁসি হওয়ার আগে পর্যন্ত আদালতের চক্কর কেটে গিয়েছেন ওই প্রৌঢ় দম্পতি। তাই কামদুনি-রায়ের খবরে দেশের আইনকানুন ও পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতাকেই দেখতে পাচ্ছেন ‘হতাশ’ আশাদেবী। তাঁর কথায়, ‘‘নিম্ন আদালতে ফাঁসি আর যাবজ্জীবনের সাজা হওয়া অভিযুক্তেরা হাই কোর্টে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে! এটা কী ভাবে সম্ভব। তবে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, বিহার-উত্তরপ্রদেশ সর্বত্র একই কাণ্ড হচ্ছে। প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা, আর প্রকৃত পক্ষে সাজা পাচ্ছে নির্যাতিতা ও তার পরিবার। ১০ বছর পরে নির্যাতিতার পরিবার জানতে পারছে যে, অভিযুক্তেরা কিছুই করেনি!’’
দিল্লি বিমানবন্দরে কাজের ফাঁকে নির্যাতিতার বাবা বদ্রীনাথও বললেন, ‘‘মেয়েটি বেঁচে থাকলে তবুও না হয় সাজা লঘু করার মতো বিষয়টি ভাবা গেলেও যেতে পারত। কিন্তু এখানে সেই সুযোগ কই? পুলিশ যদি ঠিকঠাক ভাবে সব ধারা দিয়ে থাকে, তা হলে ফাঁসির সাজা পাওয়া অভিযুক্ত জেল থেকে ছাড়া পায় কী ভাবে?’’
গত ডিসেম্বরেই দিল্লি গণধর্ষণ-কাণ্ডের ১০ বছর কেটেছে। মোমবাতি জ্বেলে মেয়ের স্মৃতি-তর্পণ করলেও আশাদেবী মনে করেন, এই এক দশকে এতটুকুও বদলায়নি দেশ, সমাজ, সমাজের ভাবনা। তাই নারী নিগ্রহ আজও সমানে চলছে। আশার কথায়, ‘‘নারী নিগ্রহ রুখতে দেশে আইনকানুন তৈরি হয়, কিন্তু সাজা হয় না। নইলে ফাঁসি ও যাবজ্জীবনের দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিও জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে! এ ভাবে তো ধর্ষকেরাই উৎসাহ পাবে। ভাববে, গণধর্ষণ করে ধরা পড়লেও মাত্র সাত বছরেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব! এ ছাড়া মেয়েদের দোষারোপ করা তো আছেই।’’
মেয়ের জন্য গত এক দশকে অনেক লড়াইয়ের শেষে ন্যায়বিচার পেয়েছেন আশা। আজ তাঁর জীবনজুড়ে শুধুই দুই ছেলে। তাঁদের মঙ্গলকামনায় গোটা দিন ধরে নির্জলা উপবাসে থেকে জিটিয়া ব্রত পালন করেন তিনি। সেই দিনে আর এক সন্তানহারা মায়ের কষ্ট, আশাভঙ্গের কান্না তাই সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন তিনি। তখনও রাজ্য সরকারের তরফে এই রায়ের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে যাওয়ার কথা জানা যায়নি। তার আগেই কামদুনির পরিবারকে নতুন লড়াইয়ে নামার বার্তা দিয়েছেন আশাদেবী। ফোনে বলছেন, ‘‘জানি, হাই কোর্টের রায়ে বড় আঘাত পেয়েছেন ওঁরা। তবে সামনে আরও কঠিন পরীক্ষা। আমি চাই, ওঁরা সুপ্রিম কোর্টে যান। হাই কোর্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে আবার কাউকে জেলে পাঠানো কঠিন জানি। তবু শীর্ষ আদালত যদি এমন দণ্ডের কারণ জানতে চায় হাই কোর্টের কাছে, সেটাও অনেক।’’