বাঁদিক থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। — ফাইল চিত্র।
২০২২ সালের ২২ জুলাই। সাতসকালে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাকতলার বাড়িতে তল্লাশি শুরু করেছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। সাড়ে ২৬ ঘণ্টা তল্লাশির পর গ্রেফতার করা হয়েছিল পার্থকে।
২০২৩ সালের ২৬ অগস্ট। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সল্টলেকের জোড়া বাড়িতে সাতসকালেই তল্লাশি শুরু করে ইডি। প্রায় ২০ ঘণ্টা তল্লাশির পর গ্রেফতার করা হয় জ্যোতিপ্রিয়কে।
দু’জনকেই যখন গ্রেফতার করা হয়, তখন তাঁরা রাজ্যের একাধিক দফতরের মন্ত্রী। কিন্তু দু’জনেরই নাম জড়িয়েছে তাঁদের পূর্বতন দফতরের দুর্নীতিতে। পার্থের হাতে তখন আর শিক্ষা দফতর নেই। তিনি তখন শিল্পমন্ত্রী। সেই সময়েই শিক্ষক নিয়োগ দু্র্নীতিতে নাম জড়ায় তাঁর। আর জ্যোতিপ্রিয়ের নাম জড়িয়েছে রেশন দুর্নীতিতে, যে খাদ্য দফতর থেকে তিনি সরেছেন বছর দুয়েক আগেই।
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দীর্ঘ ৩৪ বছরের রাজপাট থেকে বামেদের হটিয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। সে বার হাবড়া থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। জিতে খাদ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০১৬ সালেও ওই হাবড়া থেকেই প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। আবারও জয়। আবারও খাদ্য দফতর। সেই খাদ্য দফতরের আওতাধীন রেশন বণ্টন নিয়েই দুর্নীতি-বিতর্ক। অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন রেশন ডিলার এবং ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে সিন্ডিকেট তৈরি করে কেন্দ্রের পাঠানো ন্যায্য মূল্যের রেশন সামগ্রী বেআইনি ভাবে খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। তারই তদন্তে নেমেছে ইডি।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হাবড়া থেকেই প্রার্থী হয়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। জয়ীও হন। তবে এ বার আর খাদ্য দফতর পাননি। পেয়েছিলেন বন দফতর। তাঁর পূর্বতন দফতর যায় মধ্যমগ্রামের বিধায়ক রথীন ঘোষের হাতে। এই রথীন দীর্ঘ সময় মধ্যমগ্রাম পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। জ্যোতিপ্রিয়ের পুরনো দফতরকে কেন্দ্র করে যখন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তখন নাম জড়িয়েছে প্রাক্তন মন্ত্রীর। খাদ্য দফতরের বর্তমান মন্ত্রী রথীনের বাড়িতেও হানা দিয়েছে ইডি, সিবিআই। দীর্ঘ ক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাঁকে। রথীনকে রেশন দুর্নীতি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি। সিবিআই পুরনিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
রেশন দু্র্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে এর পরে গ্রেফতার করা হয় ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমানকে। ইডি সূত্রের দাবি, জ্যোতিপ্রিয়ের আমলেই উত্থান এই বাকিবুরের। অভিযোগ, বাকিবুরই সিন্ডিকেট তৈরি করে খোলা বাজারে কেন্দ্রের রেশন সামগ্রী বেআইনি ভাবে বিক্রি করতেন। তাঁকে জেরা করে যে তথ্য মেলে এবং বাজেয়াপ্ত হওয়া নথির ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার জ্যোতিপ্রিয়ের সল্টলেকের জোড়া বাড়ি এবং নাগেরবাজারের পৈতৃক ভিটেতে তল্লাশি চালায় ইডি। তল্লাশি চালানো হয় তাঁর আপ্তসহায়ক অমিত দে-র দু’টি ফ্ল্যাটেও। তার পরেই রেশন দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গভীর রাতে গ্রেফতার করা হয় জ্যোতিপ্রিয়কে। যে দফতরের দায়িত্বে তিনি নেই দু’বছর।
যেমনটা হয়েছিল পার্থের ক্ষেত্রেও। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর শিল্পমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। ২০১১ সালে স্কুল শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী হন ব্রাত্য বসু। পরে পূর্ণ শিক্ষামন্ত্রী করা হয় তাঁকে। ২০১৩ সালে ব্রাত্যকে পর্যটন দিয়ে শিক্ষা দফতর দেওয়া হয় পার্থের হাতে। ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন পার্থ। সেই সময় স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ২০১৪ সালের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা (টেট)-য় দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার পাশাপাশি অভিযোগ ওঠে যোগ্য প্রার্থীরা বঞ্চিত হয়েছেন বলেও। ২০২১ সালে হাই কোর্টের নির্দেশে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। যখন তদন্ত শুরু হয়, তখন যদিও পার্থের হাতে শিক্ষা দফতর নেই। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের পর শিল্প-বাণিজ্য, তথ্য-প্রযুক্তি ও পরিষদীয় দফতর পান তিনি। তার পরেই আতশকাচে আসে শিক্ষা দফতর। তদন্তে উঠে আসে পার্থের নাম। দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে রয়েছেন তিনি। বার বার খারিজ হয়েছে জামিনের আবেদন। এ বার পার্থের মতো হাতছাড়া দফতরের মামলায় নাম জড়িয়েছে জ্যোতিপ্রিয়ের। গ্রেফতারও হতে হয়েছে পার্থের মতো।
পার্থ, জ্যোতিপ্রিয়ের মতো কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা তল্লাশি চালিয়েছেন রাজ্যের আর এক মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বাড়িতেও। গত ৮ অক্টোবর পুরমন্ত্রী ফিরহাদের বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ফিরহাদের চেতলার বাড়িতে ওই দিন তল্লাশি চলে। তল্লাশি শেষে সে দিন ফিরহাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন সিবিআইয়ের আধিকারিকেরা। যদিও বৃহস্পতিবার জ্যোতিপ্রিয়ের বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি শেষে তাঁকে গ্রেফতার করেই বার হন ইডি আধিকারিকেরা। যেমনটা হয়েছিল পার্থের ক্ষেত্রেও।