রেশন দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন রাজ্যের বনমন্ত্রী তথা প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। যিনি রাজ্য-রাজনীতিতে ‘বালু’ নামে সমধিক পরিচিত। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মন্ত্রীর একাধিক বাড়িতে ২০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে গ্রেফতার করে ইডি। ইডি সূত্রে খবর, রেশন বণ্টন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র মিলেছে তাঁর বাড়ি থেকে।
বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটে নাগাদ বালুকে গ্রেফতার করে ইডি। তার ঘণ্টাখানেক পরে তাঁকে ইডির দফতর সিজিও কমপ্লেক্সে নিয়ে আসা হয়। সেখানে ঢোকার মুখে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বালু বলেন, “গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হলাম আমি। শুধু এটুকুই বলে গেলাম। ভারতীয় জনতা পার্টি খুব ভাল কাজ করেছে! তারা আমাকে শিকার করল।”
বালুর বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চলাকালীন বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিক বৈঠক করে মন্ত্রীর পাশে দাঁড়ান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তোলেন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগও। ইডির তল্লাশিকে ‘বিজেপির নোংরা খেলা’ বলে চিহ্নিত করে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বালুর স্বাস্থ্য খারাপ। অনেক সুগার। ও যদি মারা যায়, তা হলে বিজেপি এবং ইডি-র বিরুদ্ধে এফআইআর করতে হবে।’’
মমতার হাত ধরেই রাজ্য-রাজনীতিতে উত্থান বালুর। সত্তরের দশকে অশোক দেব এবং জয়ন্ত ভট্টাচার্যের হাত ধরে ছাত্র রাজনীতিতে এসেছিলেন তিনি। তার পর কংগ্রেসের তৎকালীন নেত্রী মমতার সঙ্গে পরিচয় জ্যোতিপ্রিয়ের। এর পরে ‘মমতার অনুগামী’ হিসাবে রাজনীতিতে পরিচিত হন তিনি।
বালুর জন্ম বর্ধমানের মন্তেশ্বরে। সেখানে তাঁদের পৈতৃক বাড়ি। তবে বাবা শক্তিপদ মল্লিক ব্যবসার কাজে কলকাতায় থাকতেন বলে বালু ও তাঁর পাঁচ ভাইয়ের বেড়ে ওঠা সেখানেই। ১৯৮৬ সালে বালুর বিয়ে হয়। স্ত্রী মণিদীপা মল্লিক। একমাত্র সন্তান প্রিয়দর্শিনী মল্লিক এখন উচ্চশিক্ষা সংসদের সচিব পদে রয়েছেন। বালুর এক দাদা স্বাধীন মল্লিক মোহনবাগান ক্লাবের কর্তা। আর এক দাদা দেবপ্রিয় মল্লিক পরিচিত চিকিৎসক। পরিবার সূত্রে খবর, বাকি দুই ভাইও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
বালুর পড়াশোনা স্কটিশ চার্চ স্কুলে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই ছাত্র রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। তার পরে আশির দশকে মমতার সঙ্গে পরিচয়।
১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছিলেন মমতা। তখন থেকেই তাঁর ঘনিষ্ঠ জ্যোতিপ্রিয়। ওই নির্বাচনে মমতার হয়ে সক্রিয় ভাবে প্রচার করেছিলেন তিনি। মমতা তাঁকে ‘বালু’ বলেই সম্বোধন করে এসেছেন বরাবর।
১৯৯১ সালে যখন কংগ্রেসের অন্দরে সোমেন মিত্র-মমতার বিরোধ শুরু, তখন মমতারই পাশে ছিলেন বালু। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল গঠনে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বালু। সেই সময় তাঁকে দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদকও করেন মমতা।
পরে উত্তর ২৪ পরগনায় দলের সংগঠন সামলানোর দায়িত্ব পান বালু। ‘পর্যবেক্ষক’ পদ দেওয়া হয় তাঁকে। পরে ওই জেলায় দলের সভাপতিও করা হয়। তাঁর সভাপতিত্বেই ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ওই জেলার ৩৩টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৩০টি আসনে জয়লাভ করে দল। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগনাকে ভেঙে একাধিক সাংগঠনিক জেলা তৈরি করা হয়। তৃণমূলশ্রুতি, তখন থেকেই বালুর ‘গুরুত্ব’ কমতে শুরু করে।
১৯৯৮ সালে তৃণমূল গঠনের পর ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম বার প্রার্থী হন জ্যোতিপ্রিয়। জিতেও যান। তাঁকে সামনে রেখেই ‘বামেদের ঘাঁটি’ গাইঘাটা দখল করেছিলেন মমতা। সে বার ৬০ জন বিধায়ক নিয়ে বিধানসভায় বিরোধী দলের মর্যাদা পায় তৃণমূল।
২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়েছিল তৃণমূল। বিধায়ক সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল ৩০। কিন্তু সে বারও গাইঘাটা থেকে জিতেছিলেন বালু। পরে ওই আসনটির পুনর্বিন্যাস হয়। তফসিলিদের জন্য সংরক্ষিত করা হয় আসনটি। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে হাবড়া থেকে প্রার্থী হন জ্যোতিপ্রিয়। জিতে দায়িত্ব পান খাদ্য দফতরের। সেই দফতরের আওতাধীন রেশন বণ্টন নিয়েই এত শোরগোল।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও হাবড়া থেকে জিতেছিলেন বালু। সে বারও তাঁকে খাদ্যমন্ত্রী করা হয়। কিন্তু গত বিধানসভা নির্বাচনে জিতে তৃণমূল তৃতীয় বার ক্ষমতা দখল করলে আর খাদ্যমন্ত্রী করা হয়নি বালুকে। তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বন দফতরের। বনমন্ত্রী থাকার পাশাপাশি অচিরাচরিত শক্তি এবং শিল্প পুনর্গঠন দফতরেরও দায়িত্ব সামলেছেন বালু।
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে হাবড়ায় প্রায় ১৯ হাজার ভোটে পিছিয়ে পড়েছিলেন দলের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার। সেই সময় বালুকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘আমি আর ভোটে দাঁড়াব না।’’ যদিও ২০২১ সালে হাবড়া থেকেই প্রার্থী হন তিনি। প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিজেপির রাহুল সিন্হা। বালু জেতেন।
২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত টানা ১০ বছর খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন বালু। অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন রেশন ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে সিন্ডিকেট তৈরি করে কেন্দ্রের পাঠানো ন্যায্য মূল্যের রেশনসামগ্রী বেআইনি ভাবে খোলা বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। তারই তদন্তে নেমেছে ইডি।
সম্প্রতি রেশন দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। মূলত তাঁকে জেরা করে পাওয়া তথ্য এবং বাজেয়াপ্ত করা নথি যাচাইয়ের পরেই বৃহস্পতিবার বালুর বাড়িতে তল্লাশি বলে দাবি করেছে ইডি সূত্র। এর আগে রাজ্যের বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী রথীন ঘোষের বাড়িতেও হানা দিয়েছিল ইডি এবং সিবিআই। তল্লাশির পাশাপাশি দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল তাঁকেও। তবে ইডি তাঁকে জেরা করেছিল রেশন দুর্নীতিতে। আর সিবিআই তাঁকে জেরা করেছিল পুরনিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে।
ইডি সূত্রের দাবি, বালু খাদ্যমন্ত্রী থাকার সময়েই বাকিবুরের উত্থান। অভিযোগ, বাকিবুরই সিন্ডিকেট তৈরি করে কেন্দ্রের রেশন সামগ্রী বেআইনি ভাবে খোলা বাজারে বিক্রি করতেন।
২০২০ সালের পর বাকিবুর-সহ একাধিক রেশন ডিলার ও ডিস্ট্রিবিউটরের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করে রাজ্য পুলিশ। নদিয়ার কোতোয়ালি থানায় করা সেই এফআইআরের ভিত্তিতেই ইসিআইআর দায়ের করে ঘটনার তদন্ত শুরু করে ইডি।
বৃহস্পতিবার বালুর বাড়িতে তল্লাশি শুরু হওয়ার পর থেকেই বাকিবুর ও বালুর সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা শুরু হয় বিভিন্ন মহলে। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, ২০২০ সালে হাবড়ায় রেশনপণ্যের বেআইনি মজুতের ঘটনা সামনে আসে। জয়গাছি রথতলা এলাকার গুদামে হানা দিয়ে প্রচুর খাদ্যসামগ্রী উদ্ধার করে পুলিশ। দু’জন গ্রেফতারও হয়।
কী ভাবে চলত দুর্নীতি? ইডি সূত্রের দাবি, মিল মালিকেরা সরকারি টাকা মিলিয়ে নিলেও মিলত না সরবরাহকৃত রেশনের হিসাব। প্রতি কেজি আটার দামে অন্তত ২০০ গ্রাম কম দিতেন আটাকলের মালিকেরা। কখনও প্রতি কেজিতে ৪০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজনে কম দেওয়া হত। ইডির দাবি, পুরোটাই চলত মিল মালিক ও সরকারি সরবরাহকারীদের বোঝাপড়ায়। সঠিক দামে কম আটা বুঝে নেওয়ার ভাল দাম পেতেন রেশনের সরকারি সরবরাহকারীরা।
বৃহস্পতিবার নাগেরবাজারে মন্ত্রীর আপ্তসহায়ক অমিত দে-র তিনটি ফ্ল্যাটেও তল্লাশি চলে। ইডি সূত্রের দাবি, অমিত ২০১২ সালে খাদ্য দফতরে গ্রুপ সি পদে যোগ দেন। তার আগে কলেজ স্ট্রিটে বই বাঁধাইয়ের ব্যবসা ছিল তাঁর। তিনি খাদ্য দফতরে যোগ দেওয়ার পরে বালুর ‘ঘনিষ্ঠ’ হয়ে ওঠেন। বালু খাদ্য দফতর থেকে বন দফতরে যাওয়ার পর অমিতও ডেপুটেশনে বন দফতরে যোগ দেন। ইডি সূত্রের দাবি, গত পাঁচ বছরে অমিতের সম্পত্তি ‘রকেটের গতিতে’ বৃদ্ধি পেয়েছে।