অবশেষে জানা গেল কলকাতা হাই কোর্টের রায়। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ
কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের দিকেই তখন তাকিয়ে সব পক্ষ। ভোট চলে এল। কিন্তু বাহিনী আর দফার হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। টানটান উত্তেজনা। কী হয় কী হয় পরিস্থিতি। শুনানি তখন মধ্যপর্বে। বলছেন বিজেপির আইনজীবী। হঠাৎই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সচিব নীলাঞ্জন শাণ্ডিল্য মোবাইল দেখতে দেখতে উঠে গেলেন কমিশনেরই আইনজীবী জিষ্ণু সাহার কাছে। সংক্ষিপ্ত কথোপকথনের পরেই জিষ্ণু বেঞ্চকে বললেন, ‘‘মাই লর্ড, আমার একটা কথা বলার আছে। এইমাত্র খবর পেলাম, কেন্দ্র আরও ৪৮৫ কোম্পানি বাহিনী মঞ্জুর করে দিয়েছে।’’
মুহূর্তে বদলে গেল আদালতের পরিস্থিতি। একটা জটিল জট যেন এক মুহূর্তে কেটে গেল। সত্যিই কেটে গেল কি না তা জানতে অবশ্য অন্তত মঙ্গলবারের শুনানি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সব পক্ষই মনে করছে, পঞ্চায়েতের ‘বাহিনী বনাম দফা’র জট কেটে গেল। কেটে তো গেল। কিন্তু লাভ হল কার? কোন পক্ষের? কে জিতছেন? কে হারছেন? আদালত চত্বরে প্রতিক্রিয়া নিতে গিয়েই বোঝা যাচ্ছিল, সবারই হাসছি কিন্তু হাসছি না পরিস্থিতি। হারজিতের দাঁড়িপাল্লায়, কমিশন-কেন্দ্র (বাহিনী নিয়ে) দীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধের পর দেখা যাচ্ছে— যুযুধান উভয় পক্ষই কিছুটা জিতলেন, কিছুটা হারলেন।কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি উদয় গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চে শুনানির সময়ই সোমবার জানা যায়, বিরোধীদের দাবি এবং কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ মেনে শেষ পর্যন্ত পঞ্চায়েত ভোটের জন্য রাজ্যে আসতে চলছে পুরো ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এই ঘোষণাকে ‘বিরোধীদের জয়’ এবং বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
অন্য দিকে, রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে কলকাতা হাই কোর্ট সোমবার সরাসরি ভোটগ্রহণের দফা বাড়ানোর জন্য আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকির আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। যদিও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী আবেদন-সহ দফা সংক্রান্ত কয়েকটি মামলা এখনও হাই কোর্টের বিচারাধীন। মঙ্গলবার তার শুনানি। কিন্তু সোমবার কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর নির্দেশের পর কমিশনের একাংশ মনে করছে, ভোটের চার দিন আগে দফা বাড়ানোর নির্দেশ দেবে না হাই কোর্ট। তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যারের সরকারের ‘জয়’ বলে একে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কারণ, বিরোধীরা একাধিক দফায় ভোট দাবি করলেও রাজ্য সরকার বরাবরই এক দফায় ভোট চেয়েছে।
সোমবার পঞ্চায়েতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে আদালত অবমাননার মামলা চলাকালীনই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের তরফে জানানো হয়, আদালতের নির্দেশ মেনে বাকি ৪৮৫ কেন্দ্রীয় বাহিনীও পাঠানো হবে বাংলায় পঞ্চায়েত ভোটের জন্য। ফলে হঠাৎই বদলে যায় মামলার সওয়াল জবাব। আদালত জানায়, সোমবার আর এই নিয়ে শুনানি নয়, পরের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার এই নিয়ে শুনানি হবে ডিভিশন বেঞ্চে। প্রথম দফায় ২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং পরে আরও ৩১৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছিল রাজ্যে। তৃতীয় দফায় ৪৮৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী এলে পঞ্চায়েত ভোটের জন্য মোট ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী আসবে রাজ্যে। যা আদতে বিরোধীদের দাবিরই স্বীকৃতি।প্রসঙ্গত, রাজ্য নির্বাচন কমিশন আদালত অবমাননা করেছে বলে পৃথক ভাবে পিটিশন করেছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং মালদহের কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু)। পঞ্চায়েতের হিংসা ঠেকাতে গত ১৩ এবং ১৫ জুন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ যে নির্দেশ দিয়েছিল, ইচ্ছাকৃত ভাবে তা মানা হয়নি বলে আবেদনকারীরা অভিযোগ জানিয়েছিলেন। এর পর ২১ জুন প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি উদয় গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছিল ৮২ হাজার (৮২২ কোম্পানি) কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে কমিশনকে। সেই নির্দেশ মেনে কমিশন বাহিনীর জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানিয়েছিল। সোমবার তা মেনে নিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মন্ত্রক।
হাই কোর্টে নাটকীয় শুনানি
প়ঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়ন নিয়ে নাটকীয় পরিস্থিতির সাক্ষী হল কলকাতা হাই কোর্ট। কমিশনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার ওই মামলার শুনানিতে জিষ্ণু প্রথমে বেঞ্চকে জানিয়ে দেন তাঁদের আবেদন মেনে বাহিনী দেওয়ার ক্ষেত্রে অপারগতার কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তিনি বলেন, “সাধারণত স্পর্শকাতর বুথে অতিরিক্ত সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। তবে এখন যা কেন্দ্রীয় বাহিনী আছে তাতে প্রতি বুথে দেওয়া সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী ভোটারদের আস্থা বাড়ানো এবং এলাকা টহলদারির জন্য রাখার চিন্তা করা হয়েছে। কারণ, ৮২২ কোম্পানি বাহিনীর ব্যবস্থা করা যায়নি। কেন্দ্র ৩৩৭ কোম্পানি দেবে বলেছে। তার মধ্যে ১১৩ কোম্পানি বাহিনী এখনও আসেনি। চলে আসবে বলেছে।”
এর পরে দিল্লি থেকে ভার্চুয়াল শুনানিতে অংশ নেওয়া বিজেপির আইনজীবী গুরুকৃষ্ণ সওয়াল শুরু করেন। সে সময়ই হঠাৎ শাণ্ডিল্য হন্তদন্ত হয়ে উঠে যান জিষ্ণুর কাছে। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নয়া নির্দেশিকার কথা জানান আদালতকে। তার পরে সওয়াল স্থগিত রেখে বেঞ্চ জানায়, মঙ্গলবার পঞ্চায়েত মামলায় আবার শুনানি হবে। আদালত অবমাননা মামলায় শুধু কেন্দ্রীয় বাহিনী নয়, আগের যত নির্দেশ সমস্তই কার্যকর করা হয়েছে কি না জানিয়ে কমিশনের কাছে রিপোর্ট চেয়েছিল হাই কোর্ট। মঙ্গলবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে আবার সেই রিপোর্ট কমিশনকে জমা দিতে হবে বলে জানিয়েছে আদালত।
পঞ্চায়েতের দফা-রফা মঙ্গলবার?
কলকাতা হাই কোর্টে পঞ্চায়েত ভোটের দফা বৃদ্ধির আর্জি জানিয়ে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন ভাঙড়ের বিধায়ক তথা আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ। তাঁর যুক্তি ছিল, হয় পঞ্চায়েত ভোটে আদালতের নির্দেশ মতো পর্যাপ্ত বাহিনী আনা হোক অথবা পঞ্চায়েত ভোটের দফা বৃদ্ধি করা হোক। আদালতের নির্দেশিত ‘২০১৩ সালের মতো বাহিনী’-র কথা মনে করিয়ে দিয়ে নওশাদ কারণ দেখিয়েছিলেন, রাজ্যে গত ১০ বছরে জেলার সংখ্যা বেড়েছে, ভোটার এবং বুথের সংখ্যাও বেড়েছে। তাই পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী না দেওয়া হলে ভোটও ২০১৩ সালের মতোই কয়েক দফায় করানো উচিত। নওশাদ জানিয়েছিলেন, ভোটারদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তাঁর এই প্রস্তাব।
সোমবার অধীরের আইনজীবীও কিছুটা একই কথা বলেছেন। তবে তিনি নিরাপত্তা সংক্রান্ত ‘বিপন্নতা’র বিষয়টি আরও নির্দিষ্ট করে জানান। অন্য দিকে, কমিশনের আইনজীবী জানিয়েছিলেন, ২০১৮ সালের মতোই এ বারেও এক দফাতেই ভোট চান তাঁরা।
আব্বাসের আবেদন খারিজ করলেও প্রধান বিচারপতি শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ সোমবার দফা বাড়ানোর বিষয়ে অধীর চৌধুরীর আবেদন গ্রহণ করেছে। মঙ্গলবার ওই আবেদনটিও শুনানি হতে পারে। যদিও মঙ্গলবার এই মামলায় দফা বৃদ্ধির আর্জি গৃহীত হলে চার দিনের মধ্যে পঞ্চায়েত ভোটের দফা বৃদ্ধি কী ভাবে হবে, সে ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত ভোট পিছিয়ে যাবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির ‘উষ্মা’
পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে একের পর এক মামলা প্রসঙ্গে সোমবার কার্যত উষ্মা প্রকাশ করেন কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম। পঞ্চায়েত সংক্রান্ত মামলার মাধ্যমে কেউ কেউ শিরোনামে (হেডলাইন) আসতে চাইছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি । মামলাকারীদের প্রত্যেকের ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ আছে বলেও জানান প্রধান বিচারপতি। আদালত কক্ষে উপস্থিত আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, “পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে অনেক মামলা দায়ের হয়েছে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনাদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রত্যেকে হেডলাইনে আসতে চান।” এই প্রসঙ্গেই তাঁর সংযোজন, “দয়া করে এর জন্য আদালতকে ব্যবহার করবেন না। দয়া করে আমাদের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করবেন না।”