‘সবুজ সাথী’র সাইকেল বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশে! —নিজস্ব চিত্র।
বাংলাদেশের গ্রাম ও মফস্সলের হাটে পুরনো জিনিসপত্র বেচাকেনার রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের। কোনও জায়গায় সপ্তাহে এক দিন, কোনও জায়গায় সপ্তাহে দু’দিন বসে এই হাটগুলি। সেখানেই বিক্রি হচ্ছে স্কুলপড়ুয়াদের জন্য তৃণমূল সরকারের দেওয়া ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল। নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া যে সব পুরনো সাইকেল কেনাবেচার দোকান রয়েছে, সেখানেই মিলছে সাইকেলগুলো।
বেশ কিছু দিন ধরে হাটে ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল বিক্রির ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ওই ভিডিয়োর সত্যতা যদিও যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। ওই ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, এক যুবক ‘সবুজ সাথী’র লোগো বসানো সাইকেলগুলি বিক্রি করছেন। সাইকেলগুলোর কোনও কোনওটা স্বল্প ব্যবহৃত, কোনওটা আবার একেবারেই নতুন। গাঢ় নীল রঙের সাইকেলগুলির সামনে বই রাখার জন্য কালো রঙের ‘বাস্কেট’ লাগানো। সাইকেলের সামনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা লোগো এবং পিছনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘বিশ্ব বাংলা’র স্টিকার সাঁটা। সত্যিই বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল? সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিয়ো দেখে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে খোঁজখবর শুরু করে আনন্দবাজার অনলাইন। তাতে উঠে এল বেশ কিছু তথ্য।
মুর্শিদাবাদ জেলা লাগোয়া ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রানিহাটি বাজার, চাঁপাই-নবাবগঞ্জ, বাথানপাড়া, নদিয়া জেলা লাগোয়া চারঘাট, রাজশাহি, খুলনা, পাবনা, গাংনি, চুয়াডাঙা, কুষ্টিয়া মেহেরপুর, জীবননগরের মতো গ্রামীণ হাটগুলিতে দেদার বিক্রি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্পের সাইকেল। বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্পে যে সব সাইকেল দেওয়া হয়, ওই একই ধরনের নতুন সাইকেলের দাম বাংলাদেশের বাজারে এখন ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল সেখানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৭-৮ হাজার টাকায়। বাংলাদেশে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাইকেল বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পশ্চিমবঙ্গে ‘সবুজ সাথী’ সাইকেলের গুণমান নিয়ে যতই প্রশ্ন করুন বিরোধীরা, সীমান্তের ও পারে এই নীলরঙা সাইকেলের কদর কিন্তু হিংসে করার মতোই!
কিন্তু সাইকেলগুলো ওখানে যাচ্ছে কী ভাবে? চুয়াডাঙা হাটের সাইকেল ব্যবসায়ী মেহেবুল কবিরাজের কথায়, ‘‘অনেকেই বলেন এগুলো নাকি পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে দেওয়া সাইকেল। আমরা অত কিছু জানি না। পাইকারদের কাছ থেকে নিয়ে আসি। ২০০-৩০০ টাকা মুনাফা রেখে বিক্রি করে দিই।’’
তা হলে কি আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে সরকারি প্রকল্পের সাইকেল বাংলাদেশে পাচার হচ্ছে? চাঁপাই নবাবগঞ্জের পুরনো সাইকেল কেনাবেচার পাইকারি এক মজুতদারের সূত্রে জানা গেল, এ দেশ থেকে মূলত দু’রকম পদ্ধতিতে সাইকেল যাচ্ছে বাংলাদেশের বাজারে। প্রথমটি হল, যে সমস্ত ভারতীয় নাগরিকের কাঁটাতারের ও পারে চাষের জমি আছে, তাঁরা সাইকেলে করে জমিতে গেলেও ফিরে আসার সময় সে দেশের বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে আসছেন সাইকেলগুলো। কারণ, এখানে বিনামূল্যে পাওয়া সাইকেল ও পারে নিয়ে গেলে ভাল দাম দিচ্ছেন বিক্রেতারা। তবে সবটাই হচ্ছে বিএসএফের নজর এড়িয়ে। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি আরও চোরাগোপ্তা। কাঁটাতারের ফেন্সিং ছাড়া এলাকা এবং শুকিয়ে যাওয়া নদীর কালভার্টের নীচ দিয়ে এ পার এবং ও পার বাংলার মধ্যে চোরা কারবার চলে। সেখানে সাইকেলও পৌঁছে যাচ্ছে বাংলাদেশে। কেমন দামে কিনতে হয় সাইকেলগুলি? কুষ্টিয়ার সাইকেল ব্যবসায়ী সুধন্য হালদারের কথায়, ‘‘৪৫০০ থেকে ৫০০০ হাজার টাকার মধ্যে সাইকেলগুলি কিনতে হয়।’’
সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় পণ্যের বেআইনি কারবার নিয়ে সে দেশের ভোক্তা অধিকার দফতর কী বলছে? সংশ্লিষ্ট দফতরের রাজশাহি ডিভিশনের আধিকারিক মুস্তফা মণ্ডল বলেন, ‘‘শুল্ক অধিদফতর বিষয়গুলি দেখাশোনা করে। বিদেশি পণ্যের নির্দিষ্ট শুল্ক এবং চালান আছে কি না, সেগুলো দেখভাল করি আমরা। সে বিষয়েও নজরদারি চলবে।’’ তবে সাইকেল যেখান থেকে আসুক, তা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নন বাংলাদেশের সাধারণ ক্রেতারা। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একই কোম্পানির প্রায় একই গুণমানের সাইকেল কিনতে গেলে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাগে। প্রায় সেই মানের সাইকেল পাওয়া যাচ্ছে সাত থেকে আট হাজার টাকায়। কেনার পরে টুকিটাকি মেরামতি করে নিলেই একদম নতুন।
এ নিয়ে জলঙ্গির তৃণমূল বিধায়ক আব্দুর রজ্জাক বলেন, ‘‘এখনকার ছেলেমেয়েরা সাইকেলের স্পোর্টস মডেল পছন্দ করছে। অনেকের বাড়িতেও দাদা-দিদিদের সাইকেল রয়েছে। বাড়তি সাইকেল অনেক সময় বিক্রি করে দেয়।’’