—প্রতীকী চিত্র।
ন্যায্যমূল্যের দোকানে বিক্রি হওয়া ওষুধের গুণগত মান ও কার্যকরিতা নিয়ে চিকিৎসক মহলে আগে থেকেই প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেরই প্রশ্ন, সত্যিই কি এত কম খরচে সঠিক গুণমানের ওষুধ তৈরি করা সম্ভব, অন্য়থায় এই বিপুল ছাড় দেওয়া হচ্ছে কী ভাবে? শুধু চিকিৎসকেরাই নয়, ওষুধ ব্যবসায়ীরাও একই প্রশ্ন তুলছেন।
২০১২-১৩ সালে অর্থাৎ একেবারে প্রথম থেকেই কৃষ্ণনগরের শক্তিনগর ও সদর জেলা হাসপাতালে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান চালাচ্ছেন গোপীনাথ দে। প্রথম থেকেই তিনি ৬০.৫ শতাংশ ছাড়় দিয়ে ওষুধ বিক্রি করে আসছিলেন। এ বছর দরপত্রের প্রতিযোগিতায় পেরে না-ওঠায় দোকান দু’টি তাঁর হাতছাড়া হয়েছে। এ বার শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের দোকানের জন্য ৮৫ শতাংশ ও সদর জেলা হাসপাতালের দোকানের জন্য ৮৩ শতাংশ ছাড়ের দরপত্র দিয়ে দোকান দু’টির পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে অন্য একটি সংস্থা।
গোপীনাথ বলছেন, “আমার পক্ষে কোনও ভাবেই ৮৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়। ন্যূনতম কার্যকারিতা বজায় রেখে এত কম দামে ওষুধ বিক্রি করার উপায় আমার জানা নেই।” তাঁর দাবি, “এত দিন অন্য হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের দোকানে ৭২ থেকে ৭৫ শতাংশ ছাড় দিয়েই আমার লোকসান হয়েছে। জানি না, এর বেশি ছাড় দিয়ে কী ভাবে গুণগত মান বজায় রাখা যায়। কিছু কিছু ওষুধ তো একেবারেইসম্ভব নয়।”
কল্যাণী জেএনএম হাসপাতাল ও চাকদহ স্টেট জেনারেল হাসপাতালের দোকান থেকে ৮৩ শতাংশ ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কোনও কোনও হাসপাতালের দোকান ৭৭ থেকে ৭৯ শতাংশ ছাড়ও দিচ্ছে। এই সমস্ত ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার মালিক অংশুমান দে রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, “এত বিশাল ছাড় দিয়ে সঠিক গুণমানের ওষুধ বিক্রি করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছে। দিন-দিন একেবারে অবাস্তব পরিকল্পনা হয়ে উঠছে।”
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের অনেকেই বলছেন, ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা নিশ্চয়ই কিছু লাভ রাখে। তার পর একাধিক হাত ঘুরে তবেই তা ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান পর্যন্ত আসে। কর্মচারি ও অন্যান্য খরচ-খরচা ধরে একটা লাভ সেই দোকানের মালিককেও রাখতে হয়। সেই হিসাবে ওষুধ তৈরি করার জন্য খুব সামান্য টাকাই পড়ে থাকে। ৮৩-৮৫ শতাংশ ছাড় দিলে একশো টাকা দামের ওষুধ তৈরির জন্য খুব বেশি হলে পাঁচ থেকে ছয় টাকা অবশিষ্ট থাকে। এতে কি সত্যিই ঠিকঠাক ওষুধ তৈরি করা সম্ভব?
জেলা সদর হাসপাতালের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ সন্দীপ মিত্র বলেন, “আমার তো এত কম খরচে সঠিক গুণগত মানের ওষুধ তৈরি করা একটা ম্যাজিক বলেই মনে হয়। যদি সত্যিই এত সস্তায় ওষুধ তৈরি করে কম দামে বিক্রি করা যায় তা হলে সরকার কেন খোলা বাজারে চড়া দামে ওষুধ বিক্রি করতে দিচ্ছে, তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।”
বস্তুত ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান চালু হওয়ার পরেই সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের একাংশের এই ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় হয়েছিল। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সরকারি হাসপাতালগুলি মূলত ওই ওষুধের উপরেই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যাঁদের সেই আস্থা নেই, তাঁদের অনেককেই রোগীর শারীরিক অবস্থা বা রোগের গুরুত্ব বুঝে সাদা কাগজে ওষুধের নাম লিখে রোগীর পরিবারের হাতে দিতে দেখা যায়। তাঁরাই বাইরে থেকে নামী সংস্থার ওষুধ কিনে আনেন। সম্প্রতি ৭৭ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়ে ওষুধ বিক্রি শুরু হতে চিকিৎসকদের মধ্যে আবার নতুন করে সংশয় তৈরি হতে শুরু করেছে। তবে নদিয়া জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জ্যোতিষচন্দ্র দাসের দাবি, “গুণগত মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই তো ওষুধগুলো বিক্রি হচ্ছে। ফলে তার কার্যকারিতা নিয়ে কোনও সংশয় থাকার কথা নয়। ঠিকঠাকওষুধই বিক্রি হয়।” (শেষ)