নতুন বছরে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিসের তীরে মিলেছে মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা ‘গুপ্তধন’। সেখানে জমা আছে বিপুল পরিমাণে ‘তরল সোনা’। ফলে পশ্চিম দেশের অর্থনৈতিক ভাগ্য দ্রুত বদলাতে চলেছে বলে স্পষ্ট করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। পাশাপাশি, এর প্রভাব গোটা আরব দুনিয়ার উপরেও পড়তে চলেছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
২০২৫ সালে ‘জ্যাকপট’ পাওয়া দেশটি হল ইরাক। গত ২০ জানুয়ারি নতুন একটি অপরিশোধিত খনিজ তেলের কুয়ো আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করে সেখানকার তেল সংস্থা ‘ইরাকি মিডল্যান্ড অয়েল’ (আইএমও)। অশোধিত ‘তরল সোনা’র খনিটি রাজধানী বাগদাদের পূর্ব দিকে অবস্থিত বলে জানা গিয়েছে।
ইরানি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সদ্য আবিষ্কৃত তৈলক্ষেত্রটিতে ২০০ কোটি ব্যারেল হালকা এবং মাঝারি শ্রেণির অপরিশোধিত খনিজ তেল জমা রয়েছে। আইএমওর ডিরেক্টর জেনারেল মহম্মদ ইয়াসিন হাসান জানিয়েছেন, ওই কূপটি থেকে দিনে পাঁচ হাজার ব্যারেল অশোধিত ‘তরল সোনা’ উৎপাদন করা যেতে পারে।
বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ খনিজ তেলের ভান্ডার রয়েছে ইরাকে। তেল রফতানিকারী দেশগুলির সংগঠন ‘অর্গানাইজ়েশন অফ পেট্রলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ়’ বা ওপেকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হল বাগদাদ। ‘তরল সোনা’ উত্তোলনের নিরিখে প্রথম স্থানে রয়েছে সৌদি আরব। দ্বিতীয় রাষ্ট্রটিই হল ইরাক।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাগদাদের কাছে মজুত রয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল। অর্থাৎ, পশ্চিম এশিয়ায় মোট জমে থাকা ‘তরল সোনা’র ১৭ শতাংশের মালিকানা আছে ইরাকের হাতে। বলা বাহুল্য, নতুন তৈলক্ষেত্র আবিষ্কারের জেরে অনেকটাই বাড়ল সেই পরিমাণ। এতে তেল মজুতের ক্ষেত্রে রিয়াধের সঙ্গে বাগদাদের ফারাক কমবে বলেও মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের দাবি, তেলের কুয়ো আবিষ্কার ইরাকের অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার আনতে পারে। কারণ পশ্চিম এশিয়ার দেশটির ৯০ শতাংশ রাজস্ব আসে ‘তরল সোনা’ রফতানি থেকে। আর তাই সেখানকার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘ইরাকি মিডল্যান্ড অয়েল’ একটি বিবৃতিতে নতুন তৈলক্ষেত্রের হদিস মেলাকে কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছে।
আইএমওর ডিরেক্টর জেনারেল ইয়াসিন হাসান বলেছেন, ‘‘নতুন তেলের খনির হদিস মেলায় উৎপাদন এবং মজুত দুটোই আমরা বাড়াতে পারব।’’ সূত্রের খবর, ১৬ হাজার কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল মজুতের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে বাগদাদ। গত বছর (পড়ুন ২০২৪) এ কথা ঘোষণা করেন পশ্চিম এশিয়ার দেশটির পেট্রলিয়ামমন্ত্রী হায়ান আবদেল ঘানি।
বাগদাদ জানিয়েছে, ২০২৮ সালের মধ্যে দৈনিক পরিশোধিত তেল উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬০ লক্ষ ব্যারেল। সে কথা মাথায় রেখে ‘তরল সোনা’ উত্তোলনের পরিকাঠামো উন্নত করা হচ্ছে। বর্তমানে দিনে ৪০ লক্ষ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে পশ্চিম এশিয়ার এই দেশ। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েক বার নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত তেল তোলার অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছে বাগদাদ। শুধু তা-ই নয়, এর জন্য বিপুল জরিমানাও আরোপ করেছে তেল রফতানিকারী দেশগুলির সংগঠন ওপেক।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ২০২৬ সাল নাগাদ ইরাকের দৈনিক তেল উত্তোলনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে আরও দু’লক্ষ ব্যারেল। তবে গত বছরের (পড়ুন ২০২৪) জানুয়ারি থেকে অতিরিক্ত তেল উৎপাদনের জন্য ওপেক যে জরিমানা করেছে, সেই টাকা এখনও দিতে পারেনি বাগদাদ। আগামী দিনে রফতানি বৃদ্ধি পেলে সেটা পশ্চিম এশিয়ার দেশটি মিটিয়ে ফেলতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নতুন তৈলক্ষেত্র আবিষ্কারের পর সংবাদমাধ্যমের কাছে এই নিয়ে মুখ খুলেছেন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ শিয়া আল-সুদানি। তাঁর কথায়, ‘‘আগামী দিনে আমরা ‘তরল সোনা’র রফতানি বৃদ্ধি করব।’’ তা ছাড়া গ্যাস আমদানির ক্ষেত্রে ইরানের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছেন তিনি। পারস্য উপসাগরের তীরের প্রতিবেশী দেশটি বাগদাদের গ্যাসের চাহিদার এক তৃতীয়াংশ পূরণ করে বলে জানা গিয়েছে।
নতুন তৈলক্ষেত্রের খোঁজ মিললেও ইরাকের সামনে বেশ কিছু আর্থিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গত শতাব্দীতে বেশ কয়েক দশক ধরে যুদ্ধে জড়িয়ে ছিল পশ্চিম এশিয়ার এই দেশ। এখনও সেখানে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ ছাড়া ব্যাপক দুর্নীতিকে বিদেশি লগ্নিকারীদের বাগদাদের প্রতি আকর্ষণ হারানোর অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়।
গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি পশ্চিমি দুনিয়ার সংস্থাগুলি ইরাকের তেলের ব্যবসা থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। জায়গা ফাঁকা হওয়ায় সেখানে বেড়েছে চিনের প্রভাব। বর্তমানে বাগদাদের তেল উৎপাদনের দুই তৃতীয়াংশ বেজিঙের সংস্থাগুলি দ্বারা পরিচালিত। একে একেবারেই ভাল চোখে দেখছে না আমেরিকা ও পশ্চিমি বিশ্ব।
২০২২ সাল থেকে ইরাকের কুর্সিতে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী আল-সুদানি। তৈলক্ষেত্রে পশ্চিমি দুনিয়ার বিনিয়োগ বৃদ্ধির মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্যেও আমেরিকার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বাগদাদ। আর তাই পুরনো শত্রুতা ভুলে কয়েক বছর আগে ওয়াশিংটন সফর করেন আল-সুদানি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরকে আংশিক সফল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ওয়াশিংটন থেকে ফেরার পর বেশ কয়েকটি আমেরিকান সংস্থা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বাগদাদের জ্বালানি ক্ষেত্রে নতুন করে বিনিয়োগ করেছে। যদিও লগ্নির মাত্রা এখনই বাড়াতে রাজি নয় তারা।
পশ্চিমি দুনিয়ার দেশগুলির মধ্যে ইরাকে অন্যতম বড় বিনিয়োগ রয়েছে ফরাসি সংস্থা টোটাল এনার্জির। একাধিক জ্বালানি সংক্রান্ত প্রকল্পের জন্য বাগদাদের সঙ্গে ২,৭০০ কোটি ডলারের গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করছে তারা। এ ছাড়া কিরকুক এলাকায় নর্থ অয়েল কোম্পানি পরিচালিত চারটি তৈলক্ষেত্রের পরিকাঠামো ঢেলে সাজাতে ব্রিটিশ সংস্থা বিপির সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করেছে আরব মুলুকের ওই দেশ।
সব ছবি: সংগৃহীত।