মমতা এবং মুকুল। ফাইল চিত্র।
কৃষ্ণনগরে বেফাঁস এবং অসংলগ্ন বক্তব্যের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঝাড়গ্রাম সফরে মুকুল রায়ের যোগ দেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত ঠিক ছিল, আগামী সোমবার বিশ্ব আদিবাসী দিবসে মমতার ঝাড়গ্রাম সফরে যোগ দেবেন মুকুলও। কিন্তু শুক্রবার দুপুরে কৃষ্ণনগরে তৃণমূলের প্রথমসারির নেতা যা বলে ফেলেছেন, তাতে তাঁর ঝাড়গ্রাম সফর নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। পাছে সংবাদমাধ্যমের সামনে আবার তিনি কিছু বলে ফেলেন, যা নিয়ে দলকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়! তবে ওই বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
শুক্রবার কৃষ্ণনগরে সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ ফস্কে মুকুল বলে ফেলেন, কৃষ্ণনগরে উপনির্বাচন হলে তৃণমূল পর্যূদস্ত হবে। বিজেপি স্বমহিমায় ফিরে আসবে। পরে শুধরে নিলেও তাঁর সেই বক্তব্যের ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, মুকুলের পিছনে দাঁড়ানো একজন তাঁকে শুধরে দেওয়ারও চেষ্টা করছেন। কিন্তু মুকুল তাতে ভ্রূক্ষেপ করছেন না। বস্তুত, তাঁর পরিচিতেরা জানাচ্ছেন, কৃষ্ণনগর ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরেও মুকুল বিষয়টি নিয়ে খুব একটা বৈকল্য দেখাননি। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁর হিতাকাঙ্ক্ষীরা। তাঁরা মনে করছেন, গত কয়েক মাস ধরে ব্যক্তিগত বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে মুকুল অভূতপূর্ব চাপের মধ্যে রয়েছেন। তারই ফলে মাঝেমধ্যে অসংলগ্ন কথা বলে ফেলছেন। মূলত সেই কারণে তিনি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলতে চাইছেন না। উল্লেখ্য, ভোটের আগে প্রচারের সময়েও মুকুল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
তৃণমূলের একটি অংশের দাবি, পটাশিয়াম-সোডিয়ামের ভারসাম্য বিগড়ে যাওয়ার ফলে মুকুল শুক্রবার কৃষ্ণনগরে ওই অসংলগ্ন কথা বলে ফেলেছেন। এমন যে হতে পারে না, তা নয়। কিন্তু মুকুলের ক্ষেত্রেও যে তেমনই হয়েছে, তা খুব জোর দিয়ে বলতে চাইছে না দলেরই একাংশ। তাদের বরং বক্তব্য, ভোটে লড়া, পুত্র শুভ্রাংশুর ভোটে হেরে যাওয়া, দলবদল এবং তার পরে পত্নীবিয়োগের মতো ঘটনাপ্রবাহ গত কয়েক মাসে মুকুলকে অনেকটাই শারীরিক এবং মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত করেছে। ফলে অতীতের চৌখস এবং মেপে কথা-বলা নেতাকে আর দেখা যাচ্ছে না। যাঁকে একটা সময়ে ‘তৃণমূলের চাণক্য’ অভিধায় ভূষিত করা হত এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা অনিল বিশ্বাসের সমতুল বলে ধরে নেওয়া হত, তিনি এখন অনেকটাই অতীতের ছায়া। যা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগে তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা।
মুকুলের এক হিতৈষীর কথায়, ‘‘দাদার শরীরটা একেবারেই ভাল যাচ্ছে না। স্ত্রী-র মৃত্যুর পরে মানসিক ভাবেও অনেকটা ভেঙে পড়েছেন। নিজে ভোটে জিতলেও হাপুন (শুভ্রাংশুর ডাকনাম) ভোটে জিততে পারেনি। সেটাও ওঁকে একটা মানসিক ধাক্কা দিয়েছে। বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিজেপি-র বিভিন্ন স্তরের নেতা যে ভাবে দাদার বিরোধিতা শুরু করেছে, তা-ও ওঁকে বিব্রত করার পক্ষে যথেষ্ট।’’ ওই হিতৈষীর আরও ব্যাখ্যা, মুকুল বরাবরই নেপথ্যে থেকে কাজ-করা নেতা। প্রত্যক্ষ পরিষদীয় বা সংসদীয় রাজনীতির চেয়ে তিনি সাংগঠনিক পর্যায়ে কাজ করতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। সে কারণেই তিনি চাননি, বিধানসভা ভোটের ময়দানে তাঁকে প্রার্থী হিসেবে নামিয়ে দেওয়া হোক। তখন থেকেই তিনি ‘অস্বাচ্ছন্দ্য’ বোধ করছিলেন। ভোটের ফলাফলও তাঁকে বড়মাপের মানসিক এবং রাজনৈতিক ধাক্কা দিয়েছে। বিজেপি-র অন্দরে তাঁর অস্বাচ্ছন্দ্য আগে থেকেই ছিল। ভোটের ফলাফলের পর তা আরও বেড়েছিল। যার প্রেক্ষিতে মুকুল পুরোন দলে ফিরে আসতে একপ্রকার বাধ্যই হন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিঠোপিঠিই তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও শোকের বিপর্যয় নেমে আসে। সব মিলিয়েই তিনি খানিকটা বিস্রস্ত হয়ে পড়েছেন।
প্রসঙ্গত, মমতা নিজে মুকুলের প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। শুক্রবারের ঘটনার পরেও সেই সহানুভূতিতে ফাটল ধরেনি। মুকুলের পত্নীবিয়োগের পর তিনি গিয়ে মুকুলের সঙ্গে দেখা করে সান্ত্বনাও দিয়ে এসেছিলেন। তৃণমূলের প্রথমসারির নেতাদের বক্তব্য, নেত্রী চান, আপাতত মুকুল বিশ্রাম নিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দিন। সেই কারণেই মুকুলের প্রস্তবিত ঝাড়গ্রাম সফর নিয়েও একটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে শনিবার দলের এক শীর্ষনেতা বলেন, ‘‘নেত্রী চাইলে মুকুল’দা ঝাড়গ্রামে যাবেন। সবকিছুই নির্ভর করছে দিদি কী বলেন তার উপর। তবে এখনও পর্যন্ত বিষয়টা খানিকটা অনিশ্চয়তার স্তরে আছে। দেখা যাক শনি আর রবিবার পরিস্থিতি কোনদিকে যায়।’’