শ্যাম বেনেগাল (১৯৩৪-২০২৪): মানুষের প্রতিরোধের ছবিকার
Shyam Benegal

ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ

১৯৩৪ সালে শ্যাম বেনেগালের জন্ম, কোঙ্কনিভাষী এক সারস্বত ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর নিজের কথা থেকে আমরা জানতে পারি, নেহরুর সমাজতন্ত্র তাঁকে খুব প্রভাবিত করেছিল।

Advertisement
রোচনা মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০৪:৫২
মধ্যমণি: মৃণাল সেন ও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে শ্যাম বেনেগাল, একটি অনুষ্ঠানে

মধ্যমণি: মৃণাল সেন ও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে শ্যাম বেনেগাল, একটি অনুষ্ঠানে

সময়টা ২০১২-১৩, ভারতে ফিল্ম সোসাইটিগুলির ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছি তখন। ষাট ও সত্তরের দশকের মুম্বইয়ে খুবই সক্রিয় এক ফিল্ম সোসাইটি ‘আনন্দম’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য গোপাল দত্তের সঙ্গে শ্যাম বেনেগালের অফিসে গিয়েছি, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের অত বড় এক জন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মোলাকাত, কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যেই, ব্যাগ থেকে নোটবুকটা বার করার আগেই আমার সব চিন্তা দূর হয়ে গেল। বইপত্র, কাগজপত্র, ডিভিডি, ফাইলে ডাঁই হয়ে থাকা ওঁর অফিসে বসে কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল ওঁর সিনেমাজীবন নিয়ে কথা বলতে বলতে।

Advertisement

যেই না তিনি শুনলেন আমি এক জন বাঙালি, ফিল্ম সোসাইটির অবদান ও ইতিহাস নিয়ে কাজ করছি, তিনি শুরু করলেন গল্প বলা— ছাত্রবয়সে তিনি যখন হায়দরাবাদ ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেই গল্প। প্রথম যে ছবিটি ওঁরা দেখিয়েছিলেন তা ছিল সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী। ছবিটা ওঁর মনে এক গভীর রেখাপাত করেছিল, যেমন আরও বহু মানুষের মনেই করেছিল। তবে অঙ্কুর (১৯৭৪)-সহ প্রথম দিকের ছবিতে শ্যাম বেনেগাল যে গ্রাম-কে পর্দায় দেখান, তা কিন্তু সত্যজিতের নিশ্চিন্দিপুরের মতো গ্রাম নয়, যেখানে সময়ের সঙ্গে প্রায় কোনও কিছুই পাল্টায় না। বেনেগাল তাঁর ছবিতে দেখিয়েছেন, শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে নিম্নবর্ণের মানুষ, কৃষিজীবী ও নারীদের উপর যে অন্যায়-অবিচার ও সামন্ততান্ত্রিক নিপীড়ন হয়ে এসেছে, দেখিয়েছেন মানুষের রাগ, প্রতিরোধ এবং বিপ্লব।

১৯৩৪ সালে শ্যাম বেনেগালের জন্ম, কোঙ্কনিভাষী এক সারস্বত ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাঁর নিজের কথা থেকে আমরা জানতে পারি, নেহরুর সমাজতন্ত্র তাঁকে খুব প্রভাবিত করেছিল। হায়দরাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করলেও, ওঁর পারিবারিক আবহে আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্র দুইয়েরই রীতিমতো জায়গা ছিল। ওঁর বাবা শ্রীধর বেনেগাল ছিলেন এক জন আলোকচিত্রী, গুরু দত্ত ছিলেন ওঁর আত্মীয়।

সৃষ্টিশীলতা ও বৈচিত্রে ভরা এক দীর্ঘ জীবনকে অল্প কথায় বাঁধা সহজ নয়। তারই মধ্যে কয়েকটি বিশিষ্টতা মাথা তোলে, সেগুলিই বলার। প্রথম কথা, বেনেগালের গোড়ার দিকের ছবিতে দেখা যায় সামন্ততান্ত্রিক পীড়নের বিরুদ্ধে তীব্র রাগ, সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের স্বপ্নও— যা আসবে একাধারে সংস্কারপন্থী প্রচেষ্টা আর বৈপ্লবিক তোলপাড়ের হাত ধরে। অঙ্কুর ছবিতে দেখতে পাই এক অনামা ছোট্ট ছেলেকে জমিদারের বাড়িতে ঢিল ছুড়তে— ওঁর অন্য নানা ছবিতেও যে বিপ্লবের রূপটা ফুটে ওঠে, তার শুরুটা যেন এখানেই। জমিদারের বখাটে ছেলের হাতে এক দলিত দরিদ্র কৃষিজীবী ও তার স্ত্রীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাগে ফেটে পড়ে সে। নিশান্ত (১৯৭৫) ছবিতে বিপ্লবের বীজ হয়ে দাঁড়ায় মহীরুহ, একটা গোটা গ্রাম বিদ্রোহ করে সামন্ততান্ত্রিক একটি পরিবারের বিরুদ্ধে। ভারতে ‘শ্বেত বিপ্লব’-এর প্রেক্ষাপটে তৈরি মন্থন (১৯৭৬) ছবিতে আমরা দেখি একটা গ্রামের ছাপোষা দুগ্ধবিক্রেতা মানুষগুলিকে সমবায় গড়ে একত্র হতে, নিজেদের সম্পদ-সম্পত্তির ভার নিজেরাই কাঁধে নিয়ে সময় ও আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে।

গ্রাম ও শহরের মধ্যে চলাচল, সামন্ততান্ত্রিক অতীত থেকে আধুনিক ভবিষ্যতের পথে যাত্রা ছিল শ্যাম বেনেগালের আগ্রহের বিষয়। তবে এই যাত্রাপথ কখনও অনায়াস ছিল না। তাই মরাঠি থিয়েটার ও ছবির বোহেমিয়ান, স্বাধীনচেতা অভিনেত্রী হংস ওয়াদকরের জীবন অবলম্বনে তৈরি ছবি ভূমিকা-তে (১৯৭৭) আমরা দেখি প্রধান চরিত্র উষার জীবন, বিয়ে ও মাতৃত্ব কোনও কিছুতেই যে সুখ খুঁজে পায় না। পেশাগত জীবনে দুর্দান্ত সাফল্য পাওয়ার পরেও সামাজিক মর্যাদা যার অধরাই রয়ে যায়। ভারতীয় চলচ্চিত্রের দুই প্রখ্যাত অভিনেত্রী শাবানা আজ়মি ও স্মিতা পাটিল যে বেনেগালের ছবি দিয়েই তাঁদের চলচ্চিত্রযাত্রা শুরু করেন, এ কোনও সমাপতন নয়। ‘নব্য’ ভারতীয় চলচ্চিত্রধারার অন্য যে আলোকচরিত্ররা— অমরীশ পুরী, নাসিরুদ্দিন শাহ, সত্যদেব দুবে, অনন্তনাগ, গিরিশ কারনাড, শামা জ়াইদি— এঁরাও তাঁর ছবিতে নানা ভূমিকায়: অভিনেতা, শিল্প নির্দেশক বা চিত্রনাট্যকার রূপে। রেখা, করিশ্মা কপূর-সহ বাণিজ্যিক ধারার হিন্দি ছবির অনেক তারকাকেই তাঁর ছবিতে নিয়েছেন তিনি, পরের দিকের ছবিগুলিতে। বেনেগালের মধ্যে এ নিয়ে কোনও অস্বস্তি ছিল না। তাঁর হাতে থাকা সব উপকরণ-প্রকরণই তিনি কাজে লাগিয়েছেন, রেখে গিয়েছেন বিচিত্র বিরাট এক চলচ্চিত্রপঞ্জি।

তাঁর কেরিয়ারের দ্বিতীয় বিশিষ্টতা— ভারতের ইতিহাসের প্রতি তাঁর আজীবন আগ্রহ ও দায়বদ্ধতা। জওহরলাল নেহরুর চমৎকার সৃষ্টি যে ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া, তাকে তিনি ৫৩ পর্বের এক টিভি শোয়ে রূপ দিয়েছিলেন দূরদর্শনে। নেহরুর প্রতি শ্রদ্ধা, সেই সঙ্গে ভারতের ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতারই প্রমাণ ছিল তা। সংবিধান নামে তাঁর তৈরি ১০ পর্বের আর একটি সিরিজ় হয়ে উঠেছিল ভারতের সংবিধানতন্ত্রের নীতিগুলির প্রতি তাঁর অনন্য শ্রদ্ধার্ঘ্য; যে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের সূত্র ধরে দেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল, সেই ইতিহাস। ইতিহাস ও সংবিধানের প্রতি এ-হেন গভীর বিশ্বাস ভারতের বা বিশ্বের আর কোন চলচ্চিত্রকারের কাজে এমন প্রতিফলিত হয়েছে তা বলা মুশকিল। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ ঘিরে রাস্কিন বন্ডের লেখা নভেলা অবলম্বনে তৈরি জুনুন (১৯৭৯) ছবিটিও তাঁর ইতিহাসপ্রীতির উদাহরণ। কলযুগ (১৯৮১) ছবিতে দেখি আধুনিক কালের শিল্প প্রেক্ষাপটে মহাভারতের কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের ছায়া। তাঁর আগের ছবিগুলিতে তিনি যে আধুনিকতার পথে যাত্রাকে তুলে ধরেছেন সহজ ভাবে, সেই যাত্রাপথে নিহিত জটিল আবেগ-অনুভূতিগুলি দেখা যায় এই দু’টি ছবিতে।

আধুনিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার, বিশেষ করে আধুনিক ভারতরাষ্ট্রের সমালোচনার দিকটি তীব্র ভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর সেই তিনটি ছবিতে, যার মুখ্য চরিত্রেরা মুসলমান নারী: মাম্মো (১৯৯৪), সরদারি বেগম (১৯৯৬) ও জ়ুবেদা (২০০১)। প্রতিটি আখ্যানই আবর্তিত নারীস্বাধীনতা ও পুরুষতন্ত্র, সৃষ্টিশীলতা ও সামাজিক মর্যাদা, সংখ্যালঘু ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের টানাপড়েন ঘিরে। প্রতিটিতেই, প্রধান চরিত্র সাধারণ মুসলমান নারী (এমনকি অনেক সময় মৃতও) যাঁদের জীবন ও দুর্ভাগ্যের আয়নায় আমরা ভারতীয় গণতন্ত্র ও আধুনিকতার অসঙ্গতিগুলি প্রতিফলিত হতে দেখি।

বিজ্ঞাপন, টিভি, তথ্যচিত্র, বায়োপিক, কাহিনিচিত্র: সব কিছুর জন্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন শ্যাম বেনেগাল। আমার কাছে তাঁর বিশিষ্টতা ইতিহাসের যুগন্ধর মানুষগুলিকে নিয়ে তাঁর আগ্রহ— নেহরু থেকে সত্যজিৎ রায়, বা মুজিবুর রহমান। যে অনায়াস দক্ষতায় তিনি ভারতীয় আর্ট ফিল্ম ও বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির মধ্যে, কিংবা টিভি তথ্যচিত্র বিজ্ঞাপন-জগতের ভিন্ন স্রোতেও তরী বাইতেন, তার জন্য তাঁকে কুর্নিশ করতে হয়।

সাউথ এশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস অ্যান্ড সিভিলাইজ়েশনস, সিনেমা অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়

Advertisement
আরও পড়ুন