হাসপাতালের বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে হচ্ছে রোগীর আত্মীদের। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
হাতে দুটো স্যালাইনের বোতল। সঙ্গে একটা ছোট কাগজের টুকরো। তাতে লেখা স্যালাইনের নাম। রোগীর এক আত্মীয়কে সেই স্যালাইন নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালের মধ্যে ঢুকতে দেখা গেল। শুধু তিনি একা নন, আরও কয়েক জন রোগীর আত্মীয়কেও বাইরে থেকে ওযুধ বা স্যালাইন কিনে আনতে দেখা গিয়েছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে। পরে জানা যায়, চিকিৎসকেরাই নাকি ছোট কাগজে ওষুধ বা স্যালাইনের নাম লিখে দিচ্ছেন রোগীর পরিবারকে। বাইরে থেকে ওষুধ বা স্যালাইন কিনে আনার কথা বলছেন। অর্থাৎ হাসপাতালের স্টকে থাকা ওষুধ বা স্যালাইন রোগীদের দিতে চাইছেন না চিকিৎসকেরা! রবিবার থেকে এমন ছবিই দেখা গেল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। যদিও এ বিষয়ে হাসপাতালের সুপার মন্তব্য করতে চাননি।
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতিদের নিম্নমানের স্যালাইন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পাঁচ প্রসূতির মধ্যে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। বাকিদের মধ্যে তিন জনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় কলকাতার এসএসকেএমে আনা হয়। কী কারণে প্রসূতিরা অসুস্থ হয়ে পড়লেন? ওই ‘নিষিদ্ধ’ স্যালাইনই কি দায়ী? এই সব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। স্বাস্থ্য ভবনের তরফে ইতিমধ্যেই এই ঘটনার তদন্তের জন্য ১৩ সদস্যের দল গঠন করা হয়েছে। তারা এসে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের বেশ কিছু ওষুধ এবং স্যালাইন পরীক্ষা করার জন্য নিয়ে গিয়েছে। তার পরই হাসপাতালের স্টকে থাকা সেই সব ওষুধ এবং স্যালাইন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ।
আপাতত হাসপাতালের কিছু ওষুধ এবং স্যালাইন ব্যবহার করা যাবে না। সেই ওষুধ এবং স্যালাইনের তালিকা দিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন মেদিনীপুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তার জেরেই বিপদে পড়েছেন হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর পরিবার। তালিকায় থাকা ওষুধ এবং স্যালাইনে বিকল্প লিখে দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু হাসপাতালের স্টকে নেই, এমন ওষুধ এবং স্যালাইনের জন্য রোগীর পরিবারের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছোট কাগজ। বাইরে থেকে রোগীর পরিবারকে সংশ্লিষ্ট ওষুধ এবং স্যালাইন কিনে আনতে হচ্ছে।
ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা গৌর ভুঁইয়া। তাঁর স্ত্রী মৌনিতারানি ভর্তি মেদিনীপুর মেডিক্যালে। স্ত্রীকে ভর্তি করানোর পরেই বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে ছোটেন গৌর। তাঁর কথায়, ‘‘হাসপাতালে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে না। বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে।’’ দিবাকর মুড়িয়া নামে এক প্রৌঢ়ের নাতনিও ভর্তি মেদিনীপুর মেডিক্যালে। তাঁর দাবি, হাসপাতালের ওষুধ এবং স্যালাইন যদি রোগীকে দেওয়া হয় তবে রোগীর পরিবারকে ‘ছাড়পত্র’ দিতে হবে। লিখে দিতে হবে ‘না-দাবি’নামা। অর্থাৎ, ওষুধ বা স্যালাইন ব্যবহারের পর রোগীর কিছু হলে তার দায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নয়! তবে অনেক রোগীর পরিবারই ‘না-দাবি’নামা লিখে দিতে রাজি নয়। বাইরে থেকেই স্যালাইন বা ওযুধ কিনে দিচ্ছেন বলে দাবি দিবাকরের।
রিঙ্গার্স ল্যাকটেট (আরএল) স্যালাইনকে কেন্দ্র করেই বিতর্ক। অভিযোগ, এই স্যালাইন আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবে তার পরও কী ভাবে তা ব্যবহার করা হল প্রসূতিদের শরীরে? এই স্যালাইনের ‘বিষক্রিয়া’ থেকেই প্রসূতিদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়নি তো? এই বিতর্কের মাঝেই মেদিনীপুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আরএল স্যালাইন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। শুধু এই স্যালাইন নয়, হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, বুপিভ্যাকসিন, র্যানিটিডিন, অক্সিটোসিন, ফেনটানাইল সিট্রেট-সহ আটটি ওষুধ বা ইঞ্জেকশন আপাতত ব্যবহারে করা যাবে না বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। যত ক্ষণ পর্যন্ত না স্বাস্থ্য দফতরের তদন্ত কমিটির পরীক্ষার রিপোর্ট আসছে, তত দিন নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। হাসপাতাল থেকে আপাতত ওই ওষুধগুলি সাপ্লাই বন্ধ থাকার জন্য বাইরে থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে আসতে হচ্ছে রোগীর আত্মীয়দের। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালের সুপার জয়ন্ত রাউত এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘কয়েকটি ইঞ্জেকশন এবং আরএল আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বিকল্প ওষুধ দেওয়া হচ্ছে রোগীদের।’’
২ জানুয়ারি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ অনলাইনে ওষুধের বরাত দেওয়ার সময়ে ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ ব্লক দেখে, তা আর বাইরে থেকে কেনা হয়নি, বরং সেটি পাশের পূর্ব মেদিনীপুরে তমলুক হাসপাতালের ভাঁড়ার থেকে আনা হয়েছিল। কিন্তু যে স্যালাইন সরিয়ে রাখার নির্দেশ রয়েছে, তা কার কথায় মেডিক্যাল কলেজে চলে এল? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষকর্তার জবাব, “এখনই কিছু বলব না। সবটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”