সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে ঘেরাটোপে থাকাকালীন জ়িনত। —ফাইল চিত্র।
বছর সাতেক আগে লালগড়ের জঙ্গলে এসেছিল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। ২০১৮-র এপ্রিলে মেদিনীপুরের চাঁদড়ায় একদল শিকারির বল্লম আর টাঙির ঘায়ে প্রাণও গিয়েছিল ওড়িশার সিমলিপালের জঙ্গল থেকে আসা ওই বাঘটিকে। এ বার ঝাড়গ্রাম জেলার সীমানায় পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে হাজির হয়েছে তিন বছরের প্রাপ্তবয়স্ক বাঘিনী ‘জ়িনত’।
বন দফতর সূত্রে খবর, এই বাঘিনিও এসেছে সিমলিপালের ব্যাঘ্র প্রকল্পের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকেই। কয়েকদিন ধরে ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুর বন বিভাগের চাকুলিয়া রেঞ্জের জঙ্গলে জ়িনতকে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে। এলাকায় কিছু গবাদি প্রাণীর দেহাবশেষ দেখে অনুমান, বাঘের হানাতেই তারা মারা পড়েছে। সীমানা লাগোয়া চাকুলিয়া ও ঘাটশিলার জঙ্গল থেকে প্রায়ই হাতি ঢুকে পড়ে ঝাড়গ্রামের জামবনি ও বেলপাহাড়িতে। কোনও ভাবে জ়িনত এ দিকে চলে এলে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বনকর্তারা।
বন দফতর সূত্রের খবর, ১৫ নভেম্বর মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে তিন বছরের জ়িনতকে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে (টাইগার রিজ়ার্ভ, সংক্ষেপে বা এসটিআর) আনা হয়েছিল। কয়েকদিন ঘেরাটোপে রেখে পর্যবেক্ষণের পরে রেডিয়ো কলার পরিয়ে ২৪ নভেম্বর তাকে সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলে ছাড়া হয়েছিল। রবি ও সোমবার জ়িনতকে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছে বলে জামশেদপুর বন বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে। সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের ক্ষেত্র অধিকর্তা প্রকাশচন্দ গোগিনেনি জানান, বাঘিনীটি সুস্থ রয়েছে এবং সিমলিপালের উত্তর সংলগ্ন ঝাড়খণ্ডের একটি জঙ্গলে ঢুকেছে। ঝাড়খণ্ড বন বিভাগকেও অবহিত করা হয়েছে। জামশেদপুর বন বিভাগ জানিয়েছে, বাঘিনিটির উপর নজর রাখা হচ্ছে। সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্প সূত্রে খবর, জ়িনতের গলায় রেডিয়ো কলার থাকায় জিপিএস ট্র্যাকারের মাধ্যমে তার গতিবিধিতে নজর রাখা হচ্ছে।
সারা দেশে ৫৭টি ব্যাঘ্র প্রকল্পে বাঘের সংখ্যা ৩,৬৮২টি। সিমলিপালে রয়েছে ২৭টি। বিভিন্ন সময়ে টাইগার রিজার্ভ থেকে বাঘ বা ‘ট্রান্সলোকেট’ করা হয়। সেই উদ্দেশ্যেই মহারাষ্ট্র থেকে জ়িনতকে আনা হয়। এতে বাঘেদের ‘জিনপুল’ উন্নত হয়। প্রাণী চিকিৎসক তথা ঝাড়গ্রাম জেলা প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের সহ-অধিকর্তা চঞ্চল দত্ত বলছেন, ‘‘ওই বাঘিনির ভিন্ রাজ্যের জঙ্গলে বিচরণ স্বাভাবিক। নতুন জায়গায় ছাড়া হলে বাঘ বা বাঘিনি সাধারণত নিজের বিচরণক্ষেত্র চিহ্নিত করে নেয়, যেখানে পর্যাপ্ত শিকার ও পানীয় জল পাওয়া যাবে এমন এলাকা। এ জন্য দীর্ঘপথ অতিক্রম করে এরা। তারপর ৩০-৪০ কিলোমিটার বৃত্তাকারে নিজের এলাকা তৈরি করে নেয়। অনুমান, এক্ষেত্রেও তেমনই ঘটছে।’’ বেলপাহাড়ি এবং লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে প্রচুর বনশুয়োর ও জংলি খরগোশ রয়েছে। জঙ্গল লাগোয়া লোকালয়ে বাসিন্দাদের গরু-ছাগলও রয়েছে। ফলে স্থানীয়রা উদ্বিগ্ন। ঝাড়গ্রামের ডিএফও উমর ইমাম বলেন, ‘‘ঝাড়খণ্ডের সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। আমাদের টিমও তৈরি আছে। নজরদারিও হচ্ছে।’’ বন দফতরের আবেদন, অযথা আতঙ্কিত হয়ে কোনও গুজব যেন কেউনা ছড়ান।
পর্যটনের মরসুমে বাঘের খবরে বেলপাহাড়ির বাসিন্দারাও। বেলপাহাড়ি টুরিজ়ম অ্যাসেসিয়েশনের মুখপাত্র বিধান দেবনাথ বলছেন, ‘‘সূর্যাস্তের আগেই পর্যটনকেন্দ্রগুলি থেকে পর্যটকদের ফিরে আসতে অনুরোধ করা হচ্ছে। জঙ্গলে কোনও ভাবেই যাতে পর্যটকরা না ঢোকেন, সেই ব্যাপারেও সতর্ক করা হচ্ছে।’’ বিধানের দাবি, পুরনো নথি অনুযায়ী, ৬০-৭০ বছর আগেও বেলপাহাড়ির জঙ্গলে বাঘের আনাগোনা ছিল। ডোমগড় গ্রামের জঙ্গল ঘেরা চাতন গুহাতে একসময় বাঘের ডেরা ছিল। তাই গুহাটির নাম ‘বাঘগুহা’। লালজলের গুহাতেও বাঘ থাকতবলে জনশ্রুতি।