(বাঁ দিক থেকে) অনুব্রত মণ্ডল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজল শেখ। —গ্রাফিক সনৎ সিংহ।
দিল্লির তিহাড় জেলে থেকেও অনুব্রত মণ্ডল এখনও বীরভূমের তৃণমূলের ‘এক নম্বর’। নিজের কালীঘাটের বাড়িতে কেষ্টর জেলার তৃণমূল নেতৃত্বের সামনে আবার তা স্পষ্ট করে বলে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্ণময় কেষ্টর জেলা-সংগঠনের বৈঠকও মঙ্গলবার ছিল যথেষ্ট ঘটনাবহুল। বৈঠকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতি কৌতুহল তৈরি করেছিল প্রথম থেকেই। বুঝতে পেরে অনুপস্থিতির ব্যাখ্যাও দেন দলনেত্রী। এই বৈঠকেই নেত্রীর ধমক খেতে হয়েছে ‘কেষ্ট-বিরোধী’ নেতা কাজল শেখকে। একই সঙ্গে পুরনো জেলা কোর কমিটি ভেঙে দিয়েছেন মমতা। সেখানেও রাখেননি কাজলকে।
মমতা বৈঠকে জানিয়ে দেন, কেষ্ট যে ভাবে বীরভূম জেলার সংগঠন পরিচালনা করতেন, সে ভাবেই সবটা চালাতে হবে। জেলা নেতাদের উদ্দেশে দিদির বার্তা, কেষ্ট নেই এক দিন বেরিয়ে আসবে। তত দিন ওর মতো করেই সংগঠন পরিচালনা করতে হবে। জেলা নেতাদের মমতা এ-ও খোলাখুলি বলে দিয়েছেন, অনুব্রত-ঘনিষ্ঠদের কোনও ভাবেই বাদ দিয়ে চলা না। অনুব্রতহীন বীরভূমে এ বারই প্রথম লোকসভা ভোট।
কেষ্ট প্রসঙ্গে মমতা
মঙ্গলবারের বৈঠকে মমতা শুধু কেষ্টর জেল-মুক্তির বিষয়ে আশাপ্রকাশ করেছেন তা-ই নয়। সূত্রের খবর, তিনি বলেছেন, কেষ্ট জেলের বাইরে এলে, তাঁকে ফের পুরনো জায়গাই ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, কেষ্টই হবেন বীরভূমের জেলা সভাপতি। মমতা এ-ও বলেন, কেষ্টর অবদান কখনও ভোলা যাবে না। এর আগে ২০২২ সালে নেতাজি ইন্ডোরের একটি সভা থেকে বীরভূমের নেতাদের মমতা বলেছিলেন, ‘‘কেষ্ট এক দিন জেল থেকে বেরোবেই। সে দিন ওঁকে নায়কের সংবর্ধনা দিয়ে বের করে আনতে হবে।’’ যদিও তার পর অনুব্রতের জেলের ঠিকান বদলে গিয়েছে। আসানসোল থেকে এখন তিনি দিল্লির তিহাড় জেলে। অনুব্রত গ্রেফতারের পর এর আগেও কালীঘাটের বাড়িতে বীরভূমের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন মমতা। সেই সময়ে নেতাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, কেষ্টর মেয়ের খোঁজ খবর রাখতে হবে। ও যাতে একাকিত্বে না ভোগে তা-ও দেখতে হবে। কিন্তু এখন সেই কেষ্ট-কন্যা সুকন্যাও গরুপাচার মামলার তদন্ত সূত্রে তিহাড় জেলে বন্দি।
কাজলকে ধমক
নতুন কোর কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা অনুব্রত-বিরোধী হিসেবে জেলার রাজনীতিতে খ্যাত কাজল শেখকে। সূত্রের খবর, মঙ্গলবারের বৈঠকে কাজলকে ধমক দেওয়ার পাশাপাশি তাঁর জন্য ‘লক্ষ্মণরেখা’ও কেটে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। তৃণমূল সূত্রে খবর, কাজলের উদ্দেশে মমতা বলেছেন, তিনি নিজেকে জেলার ‘বস্’ ভেবে নিলে ভুল করবেন। পৌষমেলার প্রশাসনিক বৈঠকে চেয়ার ছেড়ে উঠে যাওয়া নিয়েও নেত্রীর ধমক খেতে হয়েছে কাজলকে। জেলা সভাধিপতির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গোটা বীরভূম দাপিয়ে বেড়ানোর প্রয়োজন নেই বলেও তাঁকে জানিয়ে দেন মমতা। জেলা সংগঠনের কোর কমিটি থেকে তাঁকে বাদ দিয়েছেন নেত্রী। তবে কাজলকে নানুর ও কেতুগ্রাম বিধানসভা এলাকার দায়িত্ব দিয়েছেন মমতা। কেতুগ্রাম পূর্ব বর্ধমান জেলার মধ্যে হলেও তা বোলপুর লোকসভার অধীনে। দুই বিধানসভা এলাকার বাইরে কাজলের আর কোনও সাংগঠনিক ভূমিকা থাকবে না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা।
নতুন কোর কমিটি
বীরভূমে ন’জনের কোর কমিটি ছিল তৃণমূলের। নতুন কোর কমিটিতে পাঁচ জনকে দায়িত্ব দিয়েছেন মমতা। তাতে রয়েছেন চন্দ্রনাথ সিংহ, অভিজিৎ সিংহ রায়, বিকাশ রায়চৌধুরী, আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুদীপ্ত ঘোষ। কে কোন বিধানসভা দেখবেন তা-ও ভাগ করে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। কাজলের পাশাপাশি বীরভূমের সাংসদ শতাব্দী রায়কেও নতুন কোর কমিটিতে রাখেননি মমতা। তবে ভোটের আগে তৃণমূল এখন যে ভাবে সংগঠন সাজাচ্ছে, তাতে শতাব্দীকে কোর কমিটিতে রাখার কথাও নয়। কারণ সাংসদদের এখন কেবল যাঁর যাঁর এলাকাতেই সময় দিতে বলা হয়েছে। এখন যা হচ্ছে, সবটাই লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে।
বিজেপির মোকাবিলা
বীরভূমের নেতাদের উদ্দেশে মমতা বলেছেন, যেখানে বিজেপি সভা করবে, পাল্টা সেখানে তৃণমূলকেও সভা করে নিজেদের কথা বলতে হবে। তৃণমূল সূত্রে খবর, জেলা নেতাদের মমতা বলেছেন, ‘বিজেপি সবচেয়ে বড় চোর’ এ কথা বলিষ্ঠতার সঙ্গে বলতে হবে। কিন্তু তা বলা হচ্ছে না। অনেকের মতে, তৃণমূলের বিরুদ্ধে যখন বিজেপি দিবারাত্র ‘চোর চোর’ বলে আক্রমণ শানাচ্ছে, তখন জেলা ও ব্লক স্তরের নেতাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে চেয়েছেন মমতা।
জোট বার্তা
মঙ্গলবারের বৈঠকে মমতা কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে ব্যাপারেও তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন বলে খবর। বীরভূমের নেতাদের উদ্দেশে মমতা বলেছেন, জোটের রাস্তা খোলা রয়েছে। তবে একক ভাবে লড়াই করার প্রস্তুতি রাখতে হবে। প্রসঙ্গত, সোমবার সংহতি মিছিলের পর ‘ইন্ডিয়া’য় কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে নাম না-করে সমালোচনা করেছিলেন মমতা। বলেছিলেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, যে রাজ্যে যে আঞ্চলিক দল শক্তিশালী তারা সেই রাজ্যে লড়ুক। আর আপনারা ৩০০ আসনে একা লড়াই করুন। আমরা সাহায্য করব। তারা বলছে, তাদের মর্জিমতো হবে।’’ মঙ্গলবার দুপুরে অসম থেকে রাহুল গান্ধী আবার বলেছেন, ‘‘আমাদের যে আসন বোঝাপড়ার প্রক্রিয়া রয়েছে, তা চলছে। তার ফলাফল আসবে। ওই বিষয়ে আমি এখানে কোনও মন্তব্য করব না।’’ কিন্তু প্রায় এক নিশ্বাসে রাহুল বলেন, ‘‘মমতাজির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত ও দলের সম্পর্ক (রিস্তা) খুবই ভাল। হ্যাঁ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই রকম (বিতর্ক) হয়। আমাদের কেউ কিছু বলে দেন। ওঁদের কেউ কিছু বলেন। এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সে সব এতে (আসন বোঝাপড়ায়) বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।’’ তার পর সন্ধ্যায় বীরভূমের নেতাদের মমতা বার্তা দিলেন, জোটের দরজা এখনও খোলা।
অভিষেকের অনুপস্থিতি
মঙ্গলবার মমতার বাড়িতে হওয়া বীরভূমের বৈঠকে যাননি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এর আগে পশ্চিম মেদিনীপুর ও মুর্শিদাবাদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে দলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক হাজির ছিলেন। সোমবার মমতার ডাকা সংহতি মিছিলেও হেঁটেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। অভিষেক কেন মঙ্গলবারের বৈঠকে হাজির ছিলেন না, তা নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল সূত্রে খবর, কেন অভিষেক আসেননি তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মমতা। তিনি বলেছেন, অনেক নথি তৈরির বিষয় রয়েছে। তাতে সইসাবুদ করার আছে। অভিষেক সেই কাজের জন্যই বৈঠকে থাকতে পারেননি। মঙ্গলবার বৈঠক শুরুর খানিকটা আগেই অভিষেকের কনভয় তাঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্যামাক স্ট্রিটের দিকে চলে যায়।