পার্ক সার্কাস ময়দানের সভামঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: এক্স থেকে।
সোমবার তৃণমূলের সংহতি মিছিলে নেতৃত্বের ‘সংহতি’ দেখা যাবে কি না, তা নিয়ে শাসক দলের ঘরেই কৌতূহল ছিল। সেই জল্পনা এবং কৌতূহল মিটিয়ে হাজরা থেকে পার্ক সার্কাস পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা মিছিলে হাঁটলেন দলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে বেশ কিছুটা দূরে। মমতার অনেক পিছনে ছিল ‘টিম অভিষেক’। মিছিলে তাঁদের এক ফ্রেমে পাশাপাশি দেখা যায়নি। তবে পার্ক সার্কাস ময়দানের সভামঞ্চে দেখা গেল নেত্রী এবং সেনাপতি পাশাপাশি। একান্তে কানে-কানে কথাও বলতে দেখা গেল দু’জনকে। যা নিঃসন্দেহে শাসক শিবিরের কাছে ‘স্বস্তি’র বিষয়।
তবে একটা কথা শাসক এবং বিরোধী— উভয় তরফই মেনে নিচ্ছে যে, নেত্রী এবং সেনাপতির মধ্যে কোনও ‘বিরোধ’ নেই। দল পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে দু’জনের খানিক ‘মনান্তর’ হয়ে থাকতে পারে। যা রাজনীতিতে কালে কালে, যুগে যুগে হয়ে এসেছে। ‘কর্মপদ্ধতি’ নিয়ে পূর্ববর্তী প্রজন্মের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের মতবিরোধ হয়ে থাকে। মমতা-অভিষেকের মধ্যে বহুচর্চিত ‘দূরত্ব’ তার বেশি কিছু নয়। পার্ক সার্কাসের সভামঞ্চ তা আরও এক বার বুঝিয়ে দিয়েছে।
তবে মমতার পাশে মিছিলে হাঁটার কথা ছিল না অভিষেকের। কারণ, নেত্রী আগেই জানিয়েছিলেন, তিনি হাঁটবেন সর্বধর্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে। মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন তাঁরাই। সর্বধর্মের প্রতিনিধিদের সামনে ছিলেন মমতা। তাঁদের পিছনে বেশ খানিকটা জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছিল। তার পরে ছিল মূল মিছিলের জমায়েত। তারই সামনের দিকে ছিলেন অভিষেক। তাঁর পাশে দেখা গেল মন্ত্রী সুজিত বসু, জাভেদ খান, কলকাতা পুরসভার ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজরী বন্দ্যোপাধ্যায় (পারিবারিক সম্পর্কে অভিষেকের কাকিমা), ১০৯ নম্বরের অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধাননগরের মেয়র কৃষ্ণা চক্রবর্তীদের। মিছিলের পরে সর্বভারতীয় তৃণমূলের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে অভিষেকের ছবি দিয়ে লেখা হল, ‘‘দলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় হাজারো মানুষের সঙ্গে সংহতি মিছিলে শামিল হয়েছেন ঐক্যবদ্ধ ভাবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে এবং বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের উদ্যাপনে।’’
অভিষেক সোমবারের মিছিলে হাঁটবেন কি না, তা রবিবার রাত পর্যন্ত তৃণমূলের কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। তবে সোমবার বেলার দিকে তৃণমূলের তরফে মিছিলের রুট ম্যাপ প্রকাশ করা হয়েছিল। তাতেই দু’জনের ছবি স্পষ্ট করে দিয়েছিল, নেত্রীর সঙ্গে অভিষেকও শামিল হবেন মিছিলে। যদিও ‘সংহতি’ মিছিলের প্রচারে গোটা কলকাতা জুড়ে তৃণমূলের তরফে যে হোর্ডিং, ফ্লেক্স ঝোলানো হয়েছিল, তাতে কেবল মমতার ছবিই ছিল। সাম্প্রতিক নানা ঘটনাপরম্পরায় শাসকদলের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল সর্বোচ্চ নেতৃত্বের ‘সমীকরণ’ নিয়ে। মিছিলের পরে সভামঞ্চের ছবি দেখে তৃণমূলের অন্দরে ‘স্বস্তি’ই তৈরি হয়েছে।
মিছিলের ঘোষণার সময় মমতা বলেছিলেন, তিনি মিছিলের শেষে সভামঞ্চে কোনও রাজনীতিককে রাখতে চান না। যদিও মঞ্চে সর্বধর্মের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনীতিকরাও ছিলেন। মমতার এক পাশে ছিলেন ‘নবীন’ অভিষেক। অন্য পাশে ‘প্রবীণ’ সুব্রত বক্সী। মঞ্চে অভিষেক বক্তৃতাও করেছেন। যেখানে তিনি আবার টেনে এনেছেন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যের মানুষের বকেয়া পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গ। যা নিয়ে তিনি রাজ্য এবং দিল্লিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। অভিষেক বলেন, ‘‘২০১৪ এবং ২০১৯ সালে যা নিয়ে ভোট হয়েছিল, আজ (সোমবার) তা বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০২৪-এ আপনারা যদি রাস্তা, আবাস যোজনা, ১০০ দিনের কাজের দাবিতে ভোট দেন, তা হলে সেটাই বাস্তবায়িত হবে।’’ অর্থাৎ, অভিষেক বোঝাতে চেয়েছেন, রুটি-রুজির মতো মূল বিষয়গুলিকে সামনে আনলেই ধর্মের নামে রাজনীতি পরাস্ত হবে।
তবে বক্তৃতার মাঝেই অভিষেক এ-ও বলেন যে, ‘‘আমি বেশি বলব না। আমাদের সভানেত্রী আছেন। তিনিই বলবেন। আপানার তাঁর জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।’’ বেশি ক্ষণ বলেনওনি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ। সব মিলিয়ে ১২ মিনিট মাইক্রোফোন হাতে ছিল তাঁর। মাঝে আজানের জন্য কিছু ক্ষণ বক্তৃতা থামিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, রামমন্দিরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন নিয়ে রবিবারেই টুইট করে অভিষেক বলেছিলেন, লাশের পাহাড়ের উপর কোনও ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মিত হলে তা গ্রহণ করতে তাঁর ধর্ম তাঁকে শেখায় না। বক্তৃতা করতে উঠে অভিষেকের রবিবারের টুইটের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘অভিষেক তো ঠিকই বলেছে! যদি লাশের পাহাড়ের উপর কোনও ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মিত হয়, তা হলে তা গ্রহণ করতে আমার ধর্ম শেখায় না। তা সে যে ধর্মের উপাসনালয়ই হোক না কেন।’’
গত কয়েক মাস ধরে তৃণমূলের সাংগঠনিক নীতির বিষয়ে মমতা-অভিষেকের মতের ‘বৈপরীত্য’ প্রকাশ্যে এসেছে বার বার। দুই শিবিরের নেতাদের প্রকাশ্য বাগ্যুদ্ধ তাকে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিল। তার মধ্যেই অভিষেকের কিছুটা গুটিয়ে থাকা, জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে স্বয়ং মমতার সাংগঠনিক বৈঠক এবং সেখানে অভিষেকের কিছুটা ‘ঔপচারিক’ উপস্থিতি নানাবিধ ধারণা তৈরি করেছিল রাজনৈতিক মহলে। সোমবার সভামঞ্চের ছবি তাতে খানিক প্রলেপ দিল তো বটেই।