ব্যস্ততার মোড়কে ফিরেছে বেহালা। —নিজস্ব চিত্র।
কে দেখে বলবে এক দিন আগেই রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল বেহালা চৌরাস্তা সংলগ্ন ডায়মন্ড হারবার রোড! আগুন এবং কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল এলাকা। রাস্তার চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল কাঁদানে গ্যাসের শেল, ইট, কাঠ, পাথর। ঘণ্টা তিনেকের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল যানবাহন চলাচল। দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল পুলিশ এবং উন্মত্ত জনতা। কিন্তু এক দিন পরেই একে বারে অন্য চিত্র। ডায়মন্ড হারবার রোড আবার ফিরেছে ব্যস্ততার মোড়কে। ভিড় ঠেলে নিত্যযাত্রী চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, স্কুল পড়ুয়া, অভিভাবক— যে যার গন্তব্যের দিকে চলেছে। স্বাভাবিক ভাবে চলাচল করছে যানবাহন। তবে সবই হচ্ছে পুলিশের কড়া নজরদারিতে। শনিবার সকালে বেহালা চৌরাস্তার কাছে দিকে দিকে পুলিশের ছড়াছড়ি। অতিরিক্ত পুলিশি তৎপরতায় গতি কমিয়ে চলাচল করানো হচ্ছে আলিপুর এবং ঠাকুরপুকুরগামী যানবাহন। সিগন্যালের লাল আলো জ্বলার পর গাড়ির গতিবিধি এবং রাস্তা পারাপার করা জনতার দিকেও থাকছে নজর। শুক্রবারের দুর্ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার সকালে কংগ্রেসের তরফে বেহালা চৌরাস্তার কাছে রাস্তা অবরোধ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছিল। তবে পুলিশ গিয়ে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেয়।
বেহালা চৌরাস্তা সংলগ্ন ব্যস্ত ডায়মন্ড হারবার রোডের জায়গায় জায়গায় ড্রপ গেট এবং ব্যারিকেড বসানো হয়েছে। মূলত ফুটপাথ এবং রাস্তার সংযোগস্থলে যে জায়গা দিয়ে পথচারীরা রাস্তা পারাপার করেন, সেখানে এই ড্রপ গেট লাগানো হয়েছে। রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচলের সময় বন্ধ থাকছে ড্রপ গেট। পুলিশকর্তারা মনে করছেন, ড্রপ গেটের ব্যবহার সঠিক ভাবে করা গেলে দুর্ঘটনা কমবে।
তবে ছাত্রমৃত্যুকে নিয়ে এখনও চাপা ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, এত দিন ধরে একে বারেই পুলিশি তৎপরতা দেখা যাচ্ছিল না ডায়মন্ড হারবার রোডে। কিন্তু গতকালের ঘটনার কারণেই পুলিশ হঠাৎ করে এত তৎপর হয়ে উঠেছে। বেহালায় বিভিন্ন ফুটপাত এবং রাস্তা ঘিরে চলা ব্যবসার বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় বাসিন্দা তপন দত্ত বললেন, ‘‘এই সব কিছু হল ওই বাচ্চাটার প্রাণ দেওয়ার পর। আগেভাগে প্রশাসন তৎপর থাকলে ওই ধরনের দুর্ঘটনা কখনওই ঘটত না।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘ফুটপাথ দিয়ে হাঁটা যায় না। তার অর্ধেকেরও বেশি দখল। রাস্তায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণেও অনীহা। আজ তেমন ছবি নয়, কিন্তু দু’দিন পরই আবার সেই ছবি ফিরবে না তো?’’
অন্য দিকে, স্থানীয় অটো ইউনিয়নের অভিযোগ, শুক্রবারে ইউনিয়নের তরফে যারা পুলিশকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, তাদেরও কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার শাসক দলের স্থানীয় নেতৃত্বের দাবি, শুক্রবারের বিক্ষোভকারীদের ভি়ড়ে মিশে ছিল বিজেপি এবং সিপিএম কর্মীরা। তাঁদের চক্রান্তেই বিষয়টি লাগামছাড়া রূপ নেয় বলেও তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি।
শুক্রবার সকালে এই বেহালা চৌরাস্তার কাছেই এক মায়ের কোল খালি করেছিল ঘাতক লরি। লরির চাকা পিষে দিয়ে চলে গিয়েছিল বড়িশা হাই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র সৌরনীল সরকারের দেহ। লরির ধাক্কায় আহত সৌরনীলের বাবা এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সেই ঘটনার জেরে শুক্রবার সকাল থেকেই রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল ডায়মন্ড হারবার রোড বেহালা চৌরাস্তার এলাকা। ডায়মন্ড হারবার রোডেই সৌরনীলের দেহ আটকে রেখে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয়েরা। দফায় দফায় পুলিশ-বিক্ষোভকারীদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ বাধে। পুলিশের ভ্যান এবং মোটরবাইকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ভাঙচুর করা হয় সরকারি বাস। বিশাল পুলিশবাহিনী গিয়েও পরিস্থিতির রাশ নিজেদের হাতে রাখতে না পেরে ফাটায় কাঁদানে গ্যাসের শেল। পাল্টা জনতার ছোড়া পাথরের ঘায়ে আহত হয়েছেন কয়েক জন পুলিশকর্মী। এক মহিলার মুখে পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল গিয়ে লেগে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। এই ঘটনা পুলিশের প্রতি মনোভাব আরও কঠোর করে স্থানীয় বিক্ষোভকারীদের। দুর্ঘটনার ঘণ্টা চারেক পর পুলিশ এসে সৌরনীলের দেহ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করা হয়। স্বয়ং নগরপাল ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। স্বাভাবিক হয় যান চলাচল।
তবে শুক্রবার ওই দুর্ঘটনার পর থেকেই স্থানীয়দের মুখে স্রেফ একটাই কথা, ‘‘পুলিশ সচেষ্ট হলে কখনও এমন ঘটনা ঘটে!’’ একই কথা শোনা গিয়েছিল নিহত সৌরনীলের স্কুলের প্রধানশিক্ষকের মুখেও। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেছিলেন, ‘‘পুলিশ সচেতন হলে এ ভাবে আমার ছেলেটাকে মরতে হত না।’’ পুলিশের বিরুদ্ধে তোলাবাজি এবং ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও আনেন স্থানীয়েরা। স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল, ভিড়ে ঠাসা বেহালা চৌরাস্তায় সঠিক ভাবে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে না পুলিশ। ওই জায়গায় একাধিক স্কুল থাকলেও সব সময় পুলিশের দেখা পাওয়া যায় না। যদিও সিপি বিনীত গোয়াল সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে জানিয়েছিলেন, ওই জায়গাতে সব সময় পুলিশ থাকে। তবে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। এর পর ওই ঘাতক গাড়ির চালককে গ্রেফতারও করা হয়।
বেহালার পথ দুর্ঘটনার অভিঘাত এত বেশি ছিল যে, তা নাড়া দিয়েছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়কেও। নবান্ন সূত্রে খবর, পুরো ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মুখ্যসচিবকে ফোন করে কী ভাবে এই ঘটনা ঘটল তা সবিস্তারে জানতে চান মমতা। সূত্রের খবর, মমতার প্রশ্ন ছিল, কলকাতা পুলিশ যখন ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ কর্মসূচির আয়োজন করছে, তার মধ্যে এই ধরনের ঘটনা ঘটে কী করে! শুক্রবার সন্ধ্যার পর মুখ্যমন্ত্রীর ফোনও যায় সৌরনীলের পরিবারের কাছে। সৌরনীলের আত্মীয়দের সঙ্গে তিনি কথা বলে সমস্ত রকম সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। সৌরনীলের বাবা সরোজের চিকিৎসার ভারও রাজ্য সরকার নিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ঘটনাচক্রে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পরই শনিবার সকাল থেকে বেহালা চৌরাস্তায় অতিরিক্ত তৎপরতা লক্ষ করা গেল পুলিশের।