কলকাতা পুরসভার ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অনিতা কর মজুমদার (ডান দিকে)। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০১৬ সাল থেকে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। জেসিবি, পে লোডারের সঙ্গে তখন থেকেই পরিচিত কলকাতা পুরসভার ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। ২০২৪ সালের মহালয়ার সকালে যেখানে ঘটে গিয়েছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। জেসিবির ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে নবম শ্রেণির ছাত্রের। বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
অভিযোগ, কলকাতা পুরসভার এই ‘প্রান্তিক’ ওয়ার্ডটি বরাবরই বঞ্চিত। দীর্ঘ দিন ধরে সেখানে রাস্তাঘাটের অবস্থা শোচনীয়। কিন্তু প্রশাসনের তরফে সে সব রাস্তা মেরামতের কোনও প্রচেষ্টাই হয়নি। স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতেও জল জমে যায়। সেই সমস্যার সমাধানের জন্যই পাম্পিং স্টেশন তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল বছর আটেক আগে। রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ির কাজও শুরু হয় তখন থেকেই। এমনিতেই রাস্তা বেহাল ছিল। খোঁড়াখুঁড়ির পর তা হাঁটাচলার অযোগ্য হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ। দীর্ঘ দিন সেই কাজ ফেলে রাখা হয়। স্থানীয়দের দাবি, কাউন্সিলরের কাছে বার বার অভিযোগ করা সত্ত্বেও এ বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ করা হয়নি।
১৯৮৫ সালে মূল কলকাতার সঙ্গে যে সমস্ত এলাকা সংযুক্ত করা হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল বাঁশদ্রোণী, গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ, যাদবপুরের কিছু এলাকা। এগুলির মধ্যে পিছিয়ে পড়া ওয়ার্ড হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ১১১, ১১২, ১১৩ এবং ১১৪-কে। এই এলাকার বিধায়ক রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। কিন্তু রাস্তা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ দীর্ঘ দিনের।
২০১৬ সালে ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডের নিকাশি পাম্পিং স্টেশন তৈরির কাজ শুরু করে কেইআইপি। পরিকল্পনা ছিল, পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে রাস্তার জমা জল নিকটবর্তী খালে নিয়ে গিয়ে ফেলা হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে জল জমার সমস্যা মেটেনি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। তাঁরা জানাচ্ছেন, এই ওয়ার্ডগুলির দিকে নজরই দেয় না প্রশাসন। এ বিষয়ে পুরসভার তরফে জানানো হয়েছে, ২০১৬ সালে কাজ শুরু হলেও মাঝে কোভিড পর্বে দীর্ঘ দিন কাজ বন্ধ ছিল। তাই পরিকল্পনার বাস্তবায়নে সময় লেগেছে। তবে পুরসভার ১১ নং বরো সূত্রে খবর, যে ঠিকাদার সংস্থাকে ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল, সেই সংস্থা অযোগ্য। পরিকল্পনার অভাবকেই অব্যবস্থার জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
বুধবারের ঘটনার পর যাবতীয় ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে কাউন্সিলর অনিতার উপর। তিনি সকাল থেকে এক বারও এলাকায় আসেননি বলে অভিযোগ। কাউন্সিলর এক প্রতিনিধিকে এলাকায় পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয়দের তাড়া খেয়ে তাঁকে পালিয়ে যেতে হয়। আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে অনিতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। অন্তত ২০ বার তাঁকে ফোন করা হয়। তিনি ফোন তোলেননি। সকালে জানা গিয়েছিল, অনিতা স্থানীয় থানায় আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি এলাকার মানুষের সঙ্গে দেখা করবেন বলেও জানিয়েছিলেন সংবাদমাধ্যমকে। অনিতা বলেছিলেন, ‘‘এলাকায় নিকাশি ব্যবস্থার কাজ চলছে। সেই কাজ করতে তো সময় লাগে। এটা বুঝতে হবে। সাড়ে ছ’ফুট উঁচু পাইপের কাজ চলছে এলাকায়। সেখানে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এর আগে এত বড় বড় কাজ হয়েছে, এমন তো কখনও হয়নি। এই ঘটনায় আমরা মর্মাহত। মৃতের পরিবারের পাশে আছি। আর কখনও যেন না ঘটে, সেটাই চাইব।’’
এ প্রসঙ্গে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘ঘটনাটি শুনেছি। আমরা পুরসভার আধিকারিকদের সেখানে পাঠিয়েছি। এলাকায় নিকাশি ব্যবস্থার অবস্থা খারাপ ছিল। তা নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছিল। তখন এই ঘটনা ঘটেছে। দোষীরা নিশ্চয়ই শাস্তি পাবে। কনট্র্যাক্টরের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে।’’
ছাত্রমৃত্যুকে ঘিরে সকাল থেকে দফায় দফায় উত্তেজনা তৈরি হয়েছে বাঁশদ্রোণীতে। পাটুলি থানার ওসিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘেরাও করে রেখেছিলেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁকে কাদাজলে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। পরে পুলিশ গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে। ঘটনাস্থলে কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার প্রদীপ ঘোষাল পৌঁছলে তাঁকেও ঘিরে ধরে উত্তেজিত জনতা। সন্ধ্যায় বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে যান কলকাতা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ শহরতলি) বিদিশা কলিতা দাশগুপ্ত। শুরু হয় ধরপাকড়। তার পর পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে খবর।