জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক —গ্রাফিক সনৎ সিংহ।
মঙ্গল এবং বুধবার তাঁর থাকার কথা ছিল বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ আলো করে। আয়োজনের খুঁটিনাটি, মহাযজ্ঞের যাবতীয় প্রস্তুতিতে জড়িত থাকার কথাও ছিল তাঁরই। অন্তত প্রশাসনিক ভাবে। কিন্তু তিনি কারান্তরালে। বুধবার যখন দক্ষিণ কলকাতার ধন ধান্য প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্য সম্মেলনের সমাপ্তি হবে, তখন তিনি থাকবেন তার অদূরেই। প্রেসিডেন্সি জেলে।
তিনি—মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। রেশন দুর্নীতি মামলায় ইডির হাতে গ্রেফতার হয়ে আপাতত যাঁর ঠিকানা প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগার। তাঁর শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উদ্বিগ্ন শাসক শিবিরের অন্দরে তাঁর হিতৈষীরা এবং রাজ্য মন্ত্রিসভায় তাঁর সহকর্মীরাও।
মমতার প্রথম দু'টি সরকারের খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। যিনি ‘বালু’ নামেই সমধিক পরিচিত রাজনীতির বৃত্তে। কিন্তু তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসে বালুকে খাদ্য থেকে সরিয়ে বনে পাঠিয়ে দেন মমতা। যদিও গত ১১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার দফতর রদবদলে বালুর গুরুত্ব খানিক বাড়িয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বন দফতরের পাশাপাশি বালুকে দেওয়া হয়েছিল শিল্প ও পুনর্গঠন দফতর। শশী পাঁজার হাত থেকে নিয়ে বালুকে ওই দফতর দেওয়া নিয়ে আমলামহল তো বটেই শাসকদলের মধ্যেও বিস্তর আলোচনা হয়েছিল।
শিল্প ও পুনর্গঠন মন্ত্রী হিসেবে বালুর মঙ্গল-বুধবার বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে তা হচ্ছে না। প্রসঙ্গত, মূল শিল্প দফতরটি রয়েছে শশীর হাতেই। শিল্প ও পুনর্গঠন একটি পৃথক দফতর। যা শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
নতুন দফতরের দায়িত্ব পেলেও ঘটনাপ্রবাহে বালু তেমন ভাবে কাজ শুরু করতে পারেননি। মাসদেড়েকের মাথায় রেশন দুর্নীতিতে গ্রেফতার হয়ে যান। ১১ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব পেয়েছিলেন বালু। ২৭ অক্টোবর তাঁকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। অর্থাৎ মাত্র দেড় মাস তিনি কাজ করেছেন। বালু আপাতত জেলে থাকলেও মন্ত্রী রয়েছেন। তাঁর দফতরও রয়েছে। কিন্তু শিল্প পুনর্গঠন মন্ত্রী থাকলেও বাণিজ্য সম্মেলনে বিনিয়োগের প্রস্তাব, মউ স্বাক্ষর বা কর্মসংস্থান সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর উপস্থিতি থাকবে না।
প্রসঙ্গত, তৃতীয় মমতা সরকারের গোড়া থেকেই বালুর ‘গুরুত্ব হ্রাস’ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে শাসকদলের মধ্যে। শুধু প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বালুর গুরুত্ব কমেছিল তা-ই নয়, সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও ক্ষমতা ‘খর্ব’ করা হয়েছিল তাঁর। বালু ছিলেন তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সভাপতি। কিন্তু ২০২১ সালে বিধানসভা ভোট মিটে যাওয়ার পরেই সাংগঠনিক পুনর্বিন্যাস করে শাসকদল। একটি প্রশাসনিক জেলাকে একাধিক সাংগঠনিক জেলায় ভেঙে দেওয়া হয়। উত্তর ২৪ পরগনাতেও চারটি সাংগঠনিক জেলা কমিটি তৈরি করে তৃণমূল। ফলত, সন্দেশখালি থেকে সল্টলেক পর্যন্ত বিস্তৃত জেলার সংগঠনে বালুর যে ‘একচেটিয়া’ আধিপত্য ছিল, তা-ও ধাক্কা খায়। অনেকেই মনে করেন, সেই প্রেক্ষাপটে গত ১১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভায় বালুর ‘গুরুত্ব’ বৃদ্ধি ছিল রাজনৈতিক ভাবে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। শাসকদলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের ক্ষেত্রেও ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’। কিন্তু সেই গুরুত্ব খুব বেশিদিন উপভোগ করতে পারেননি বালু।
বাণিজ্য সম্মেলনের সময় শিল্প ও পুনর্গঠন মন্ত্রীর কারাবন্দি থাকা কি বিড়ম্বনার? তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষ মঙ্গলবার অবশ্য সাফ বলেন,‘‘এটা কোনও বিড়ম্বনার বিষয়ই নয়। যে সম্মেলন শুরু হচ্ছে, তা নতুন শিল্প আনার। এর সঙ্গে শিল্প পুনর্গঠনের কোনও সম্পর্ক নেই।’’ যদিও বিরোধীরা প্রত্যাশিত ভাবেই কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী অনেক বড় আয়োজন করেছেন। শুনলাম দেশবিদেশের অনেকে আসছেন। তাঁরা যদি বলেন, শিল্প পুনর্গঠনমন্ত্রীকে দেখছি না তো! তাঁদের কি প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়া হবে?’’ আর রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ীর বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলের কাছে একটাই শিল্প, সেটা হল চুরি। কী কী ভাবে, কোন কোন পদ্ধতিতে তা পুনর্গঠন করা যায় তার জন্যই বোধহয় জ্যোতিপ্রিয়কে ওই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাঁর যেখানে থাকার কথা, তিনি সেখানেই রয়েছেন।’’