ধর্নার কর্সমূচির ডাক জুনিয়র ডাক্তারদের। ছবি: সারমিন বেগম।
জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি কি উঠবে, দিনভর এই আলোচনাই চলেছে বিভিন্ন মহলে। কর্মবিরতি উঠলে তাঁদের আন্দোলন কোন পথে এগোবে, তা নিয়েও বিস্তর কাটাছেঁড়া চলে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত প্রায় ১০ ঘণ্টা জুনিয়র ডাক্তারদের প্যান জিবি (জেনারেল বডি) বৈঠকেই ঠিক হয়ে যায় পরবর্তী কর্মসূচির রূপরেখা। শুধু ঘোষণা ছিল সময়ের অপেক্ষা। ঠিক হয়েছিল এসএসকেএম থেকে মিছিল করে ধর্মতলায় এসে তাঁরা আগামী আন্দোলনের কথা জানাবেন। সেই মতো শুক্রবার রাতে জল্পনার অবসান ঘটিয়ে কর্মবিরতি তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তবে কর্মবিরতি তুললেও আন্দোলন থামছে না, তা স্পষ্ট করে দেন তাঁরা। ঘোষণা, রাত থেকেই ধর্মতলার ওয়াই চ্যানেলে অবস্থান শুরু করছেন আন্দোলনকারীরা। একই সঙ্গে ধর্নামঞ্চে তাঁরা একটি বড় ঘড়ি টাঙিয়ে দেন। সেই ঘড়িকে সামনে রেখে রাজ্য সরকারকে সময় বেঁধে দিলেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। যদি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরকার তাঁদের দাবি না মানে তবে আমরণ অনশনের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তাঁরা।
৩০ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আরজি কর মামলার শুনানিতে জুনিয়র ডাক্তারদের আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ জানিয়েছিলেন, ওপিডি ও আইপিডি উভয় ক্ষেত্রেই জরুরি পরিষেবা দিচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। ইন্দিরা সুপ্রিম কোর্টে এই আশ্বাস দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স’ ফ্রন্ট’ বৈঠকে বসেছিল। প্রায় আট ঘণ্টার জিবি বৈঠকের পর পূর্ণ কর্মবিরতিতে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা। এক দিকে যখন সুপ্রিম কোর্টে ইন্দিরা আশ্বাস দিয়েছেন, অন্য দিকে পর ক্ষণেই জুনিয়র ডাক্তারদের এই পূর্ণ কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত— এই ঘটনাগুলি কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়েও চর্চা শুরু হয় চিকিৎসক মহলে। কর্মবিরতির পথ থেকে সরে এসে আন্দোলনকে ‘অন্য মোড়কে’ ফেলার পক্ষে মত দিয়েছিলেন অনেকেই। সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার রাত থেকে চলা বৈঠকেও এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয় জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে। একাংশ কর্মবিরতি চালিয়ে পক্ষে থাকলে, অনেকেই নাকি বিকল্প পথে হাঁটার দিকেই ঝুকেছিলেন। তাঁদের দাবি, আন্দোলনের প্রথম দিন থেকে সাধারণ মানুষকে তাঁরা পাশে পেয়েছেন। স্বাস্থ্য ভবনের সামনে অবস্থানের সময়ও নাগরিকরাই এগিয়ে এসেছেন সাহায্য নিয়ে। এমন পরিস্থিতি কর্মবিরতি চালিয়ে গেলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বেন সাধারণ মানুষই। আন্দোলনে তাঁদের পাশে পেতে বিকল্প পথে যাওয়ার কথা ভাবা উচিত বলে মত দেন জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ।
কর্মবিরতি তোলার পরামর্শ সিনিয়র চিকিৎসকেরাও দিয়েছিলেন। সেই সব নিয়েও আলোচনা হয় জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে। বুধবার মহালয়ার দিন জুনিয়র ডাক্তারদের যে সমাবেশ হয়েছিল ধর্মতলায়, তাতে আন্দোলনের অন্যতম মুখ দেবাশিস হালদার-সহ অনেকের বক্তব্যেই ‘রোগীস্বার্থ’ বিষয়ে জোর ছিল। বৃহস্পতি-শুক্রের প্যান জিবিতেও অনেকের বক্তব্যে সেই প্রসঙ্গটি আসে। ঠিক হয় এসএসকেএম থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিল শেষেই জুনিয়র ডাক্তারেরা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।
কথা মতো শুক্রবার দুপুরে এসএসকেএম হাসপাতালের সামনে থেকে মিছিল শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁদের সেই মিছিলে পা মেলান সিনিয়র ডাক্তারেরা। ছিলেন সাধারণ মানুষও। রবীন্দ্র সদন হয়ে পার্ক স্ট্রিট ছুঁয়ে মিছিল এসে পৌঁছয় ধর্মতলায়। মিছিল ধর্মতলায় পৌঁছতেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অভিযোগ, মিছিল পৌঁছনোর আগে তাঁদের এক সতীর্থের সঙ্গে অভব্য আচরণ করেন পুলিশের এক আধিকারিক। মেডিক্যাল কলেজের ওই ইন্টার্নকে লাথি মারা হয় বলেও অভিযোগ। এমনকি, তাঁকে টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার একটি ভিডিয়ো (যদিও তার সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন) পুলিশের কাছে দেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। দাবি, ‘অভিযুক্ত’ ওই পুলিশ আধিকারিককে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে।
সেই দাবিতেই ধর্মতলায় রাস্তার উপর বসে পড়েন আন্দোলনকারীরা। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলে সেই অবস্থান। পুলিশ এসে অবস্থান তোলার অনুরোধ করলে শুরু হয় কথা কাটাকাটি। পুলিশের তরফে বিকল্প জায়গায় অবস্থানে বসার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলে দীর্ঘ ক্ষণ। অবশেষে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ ধর্মতলা থেকেই সাংবাদিক বৈঠক করে নিজেদের পরবর্তী কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
উল্লেখ্য, শুক্রবারের মিছিলের একে বারে সামনের সারিতে ছিল ট্যাবলো। সেই ট্যাবলো রাখা ছিল একটি বড় ঘড়ি। যা নিয়ে সকলের মনে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। কেন এই ঘড়ি নিয়ে এসেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা, প্রশ্ন ওঠে অনেকের মনেই। সাংবাদিক বৈঠকে সেই প্রশ্নের জবাব দেন আন্দোলনকারীরা। জুনিয়র ডাক্তারদের পক্ষে দেবাশিস বলেন, ‘‘জিবি করে আমরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সম্পূর্ণ ভাবে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হবে। তবে তার সঙ্গে আমরা তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যাব এই ধর্মতলাতেই। আমরা জুনিয়র ডাক্তারেরা লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির ডাক দিচ্ছি।’’ পাশাপাশি তাঁদের সঙ্গে আনা ঘড়ি ধর্নামঞ্চে টাঙিয়ে দেওয়া হবে বলেও জানান জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘আমরা এই ঘড়ি নিয়ে এসেছি। প্রতি মিনিট, ঘণ্টার হিসাব হবে। তাই এই ঘড়ি অবস্থান মঞ্চে থাকবে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় যদি সরকার আমাদের দাবি না মানে, তবে আমরা জীবনের বাজি রেখে আমরণ অনশন শুরু করব।’’
শেষে জুনিয়র ডাক্তারেরা এ-ও স্পষ্ট করেন, কোনও চাপে পড়ে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করছেন না তাঁরা। দেবাশিস বলেন, ‘‘আমরা কোনও চাপের মুখে পড়ে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করছি তা একদমই ঠিক কথা নয়। আমরা বাধ্য হয়ে কর্মবিরতিতে গিয়েছিলাম। তবে সাধারণ মানুষের পরিষেবার কথা মাথায় রেখেই আমরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করছি।’’ আর এক আন্দোলনকারী অনিকেত মাহাতো জানান, তাঁরা এই আন্দোলনের মাধ্যমে সিবিআইকেও চাপে রাখতে চান।