কিছু দিন আগে হরিয়ানার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনবিদ্যার এক ছাত্রকে পরীক্ষায় নকল করার অভিযোগে অকৃতকার্য ঘোষণা করা হল। ছাত্রটির দোষ, তাঁর কাজে কৃত্রিম মেধা (এআই) ব্যবহৃত হয়েছিল। ছাত্রটি আদালতে আবেদন করে জয়ী হন— বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে পাশ করাতে বাধ্য হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আর কৃত্রিম মেধাকে ব্রাত্য করে রাখা ঠিক হবে কি না, সে বিষয়ে স্বভাবতই বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
কৃত্রিম মেধা এখন আমাদের জীবনের অঙ্গ। মোবাইলে টেক্সট মেসেজ পাঠানোর সময় দু’-একটা শব্দ লেখামাত্র— অথবা তারও আগে— প্রায় পুরো বাক্যটাই ফুটে ওঠে। প্রথম-প্রথম এতে বিরক্ত হলেও, আজকাল আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে; এআই প্রস্তাবিত বাক্যাংশ দিব্য ব্যবহার করছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করা হচ্ছে, গান-কবিতা লেখা, ছবি আঁকাও হচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে নানা প্রশ্ন, নানান বিতর্কের অবকাশ আছে। হরিয়ানার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটা এক বিশেষ সমস্যাকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। প্রশ্ন হল, শিক্ষায়, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনায় সরাসরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি কাজে লাগানো উচিত? লাগালে, কী ভাবে? শিক্ষার ক্ষেত্রে আদৌ কি এটা একটা সমস্যা, না কি সুযোগ?
পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তির অভাব নেই। দলের বিভাজনটাও সহজবোধ্য— এক দিকে ছাত্রদল, যাঁরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার চান; উল্টো দিকে শিক্ষককুল, যাঁরা এআই-কে শিক্ষাদান ও শিক্ষালাভের অন্তরায় বলেই মনে করেন। অনেকের মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষা-সহায়ক এক প্রযুক্তি— ‘লার্নিং এড’। কৃত্রিম হলেও বুদ্ধিমত্তা তো বটেই; অতএব, শিক্ষায় অবশ্যই ব্যবহার্য। বরং, আজকের যুগে এর ব্যবহার না করাটাই মূর্খামি। যেমন, আমরা নানাবিধ কাজে ক্যালকুলেটর বা বিভিন্ন সফটওয়্যারের সাহায্য নিয়ে থাকি, তেমনই, উচ্চশিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে উচ্চ, এমনকি প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রেও নানা কাজ সহজে করা যায়।
ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে দ্বিতীয় যুক্তি হল, জ্ঞান আহরণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জুড়ি নেই। অধ্যয়ন যদি ছাত্রদের তপস্যা হয়, তা হলে তার আধুনিক স্থান আর গ্রন্থাগার নয়, আন্তর্জাল। শুধুমাত্র বই পড়েই যে আধুনিক জ্ঞানলাভ হতে পারে তা নয়; চটজলদি কোনও সমস্যার সমাধান পেতে অথবা যে কোনও জটিল প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে চ্যাট-জিপিটির শরণ নিলে ক্ষতি কিসের?
তৃতীয়ত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নেওয়ার অর্থ চুরি করা বা নকল করা নয়। কোনও রচনা লেখা অথবা প্রোজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করার আগে প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য জোগান দেয় এআই— সে সব নোটস-এর ভিত্তিতেই ছাত্ররা তাঁদের কাজ সম্পূর্ণ করেন; এই পদ্ধতিতে কাজ করাকে কোনও মতেই বেআইনি বলা চলে না।
উল্টো দিকে, অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা এআই তো দূর, অঙ্কের ক্লাসে আজও ক্যালকুলেটরের ব্যবহারই মেনে নিতে পারেন না। তাঁদের মতে, অত্যধিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছাত্রছাত্রীদের মানসিক উন্নয়ন, মস্তিষ্কের গঠন, বুদ্ধিমত্তার বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়। নিজে হাতে লিখে, অঙ্ক কষে, জটিল প্রশ্নের সমাধান খুঁজে বার করাটাই ছাত্রছাত্রীদের কাজ— শিক্ষকের দায়িত্ব সেই কাজে ছাত্রছাত্রীদের সমর্থ করে তোলা। ছোটবেলায় নামতা শিখলে কথায় কথায় ক্যালকুলেটরের বোতাম টেপার দরকার হয় না। এই শিক্ষকরা মনে করেন, জ্ঞানার্জনের জন্য লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ার কোনও বিকল্প নেই। ছাত্রছাত্রীরা নিজেরা নানা বই ঘেঁটে নিজেদের নোটস তৈরি করবেন, সেটাই কাম্য।
উত্তরে আধুনিক ছাত্রছাত্রীরা বলবেন, যুগের ধর্ম মেনে শিক্ষকদের নিজেদের মানসিকতা বদলাতেই হবে। নামতা মুখস্থর জমানা শেষ; বৈজ্ঞানিক ক্যালকুলেটর ব্যাবহার না করলে আমরা নিজেরাই পিছিয়ে পড়ব। আগের শতাব্দীতে আমরা যখন খাতায়-কলমে অনেক সময় ধরে অঙ্ক কষেছি, তখন আমেরিকার ছাত্রছাত্রীরা তো প্রযুক্তির সহায়তায় তাঁদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই বিতর্কে আদালত যা-ই মত দিক না কেন, তর্কের অবসান এত সহজে ঘটবে না।
ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের মাঝে অবশ্য আরও দুই পক্ষ আছেন— এক, অভিভাবক; আর দুই, শিল্পপতি। এঁরাও এই তর্কের ভাগীদার। অভিভাবকরা শিক্ষকদের কাছে জানতে চান, বাড়িতে ছেলেমেয়েদের তাঁরা কি প্রযুক্তির ব্যবহার বারণ করবেন, না কি উৎসাহ দেবেন। সব পিতামাতাই আশা করেন যে, তাঁদের সন্ততি যেন অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে না-পড়ে। অগত্যা, পুরনো পদ্ধতিকে আঁকড়ে ধরে রাখার উপায় নেই; এআই-এর জয়জয়কার তাই আজ ঘরে ঘরে।
আর আছেন শিল্পপতিরা, আগামী দিনে যাঁরা আজকের কলেজের ছাত্রছাত্রীদের তাঁদের কাজে নিয়োগ করবেন। যে কোনও শিল্পেই আজকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হচ্ছে। বড় বড় সব আন্তর্জাতিক সংস্থায় এখন কর্মীদের শেখানো হয় কী ভাবে এআই-সহযোগে প্রোজেক্ট তৈরি করতে হবে। আগামী দিনে তা বাড়বে বই কমবে না। অতএব, আজকের উচ্চশিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাদ দেওয়ার অর্থ হল, ছাত্রছাত্রীদের এই একটি ক্ষেত্রে অদক্ষ হয়ে থাকতে বাধ্য করা। শিক্ষক হিসাবে এ কথা মেনে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। বরং শিক্ষকদেরই হয়তো নিজেদের শিক্ষা নিতে হবে— এআই ব্যবহারের শিক্ষা; আগামী দিনের উপযোগী কর্মী গঠনের শিক্ষা।
(অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি)