‘পাঠাগারের বই চুরি করে পুজোয় ভোজ’ (৭-১১) শীর্ষক খবরটি নজর কাড়ল। ব্যতিক্রমী এই সংবাদটি পড়ে মনে এল গত শতকের শেষ ভাগে প্রত্যক্ষ করা রাজ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একটি দৃশ্যের কথা। আসন্ন এমএ পার্ট টু পরীক্ষার প্রস্তুতির লক্ষ্যে বিভাগীয় লাইব্রেরিতে হাজির জনাকয়েক পড়ুয়া। তাদের দাবি, অবিলম্বে দু’টি করে বই দিতে হবে প্রত্যেককে। মাঝবয়সি মহিলা গ্রন্থাগারিক বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, কার্ডপিছু একটি বই-ই বরাদ্দ। এটাই নিয়ম, না হলে খাতা পেন নিয়ে বসে লিখে নিতে হবে।
কিন্তু গ্রন্থাগারিকের বোঝানোর সেই চেষ্টা বিফলে যায়। এর পরে শিক্ষার্থীর দল অতি সন্তর্পণে শেক্সপিয়র ও ইয়েটস-এর অমূল্য রেফারেন্স বইয়ের কিছু পৃষ্ঠা ছিঁড়ে দ্রুত পকেটস্থ করে। দলের কয়েক জন ছাত্রীও তাদের দোপাট্টার আড়ালে লুকোয় বাকি ছেঁড়া অংশগুলো। এর পরে বইগুলোকে যথাস্থানে সাজিয়ে রেখে যুদ্ধজয়ের হাসিতে তারা বেরিয়ে যায়। সিসি ক্যামেরার নজরদারি না থাকায়, এমন গর্হিত কাজটি তখনকার মতো অগোচরেই থেকে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় অন্য পড়ুয়ারা যাদের বইগুলি প্রয়োজন ছিল। বহুকাল বাদে কর্মজীবনে উচ্চস্তরে পড়ুয়াদের অনুরূপ হাতসাফাইয়ের কাহিনি শুনেছি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আমার এক সহকর্মীর কাছ থেকে, যিনি স্বয়ং এ-হেন কর্মটি বার কয়েক করেছিলেন।
বাস্তবিকই, কয়েক জন পাঠকের অপাঠকোচিত আচরণ শিক্ষাঙ্গন বা গ্রামীণ গ্রন্থাগারগুলির শৃঙ্খলা ও নিয়মবিধি নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পাঠাগারের অন্দরে ছোট ছোট জটলা করে উচ্চৈঃস্বরে কথাবার্তা ও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় প্রকৃত পাঠকের একাগ্রতা হারিয়ে যায়। তা ছাড়া মোবাইলের বিচিত্র আওয়াজে গ্রন্থাগারের পরিসরটির নীরবতাও হারিয়ে যায় বিভিন্ন সময়ে। ঠিক সময়ে বই ফেরত না দেওয়া অথবা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে একই বই বারংবার হস্তগত করা থেকে শুরু করে পড়ার পর বইটিকে নির্দিষ্ট জায়গায় না রেখে চলে যাওয়া, বইয়ের পাতায় দাগ বা নিজের নাম লিখে রাখাও ব্যতিক্রম নয়। একা গ্রন্থাগারিকের পক্ষে সমস্ত কিছু নিখুঁত ভাবে দেখা সম্ভব হয় না। নিয়োগ না হওয়ায় বহু ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারিকের পদ শূন্য থেকে যায় বছরের পর বছর। নামমাত্র ফাইনকে তুড়ি মেরে এগিয়ে যায় নিয়ম না-মানার সংস্কৃতি।
সুপ্রতিম প্রামাণিক, আমোদপুর, বীরভূম
বৈষম্যের ছবি
পাঠাগার থেকে বই চুরির সংবাদটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক। অভিযুক্ত ছাত্রটি গ্রেফতার হয়েছে ও জুভেনাইল আদালতের নির্দেশে তাকে হোমে রাখা হয়েছে। নাবালকের কাজটি নিঃসন্দেহে গর্হিত। তবে এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা উচিত নয় কি যে, এই ধরনের অসামাজিক কাজ কেন করল সে? সংবাদে প্রকাশ, ছেলেটির পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল নয়। বই বিক্রি করে পুজোয় ভালমন্দ খাওয়াদাওয়া করেছে সে। তথ্যটির মাধ্যমে সামঞ্জস্যহীন এক সমাজ ব্যবস্থার ছবিই কি এ ক্ষেত্রে ফুটে ওঠে না? আজ এই বৈষম্য ও বিবিধ প্রলোভনের জেরেই অপরিণত বয়সে বহু ছেলেমেয়ে বিপথে পা বাড়াচ্ছে। সময় থাকতে এই সামাজিক অবক্ষয় রোধ করতেই হবে।
অন্য দিকে, চুরির জিনিসপত্র কেনাবেচা করা ওই ব্যক্তির কথা ভেবেও অবাক লাগছে। নাবালক ছাত্রটি দিনের পর দিন যখন ওই সব বই এনে তাঁকে দিচ্ছিল তখন তিনি নির্দ্বিধায় সেগুলি কিনে নিলেন কেন? এক বারও কি তাঁর মনে কোনও সন্দেহ হয়নি? না কি ব্যবসার লাভের কথা ভেবে ওই নাবালক ছাত্রটিকে তিনিও অপরাধের দিকে ঠেলে দিলেন? আজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে আমাদের মানসিকতা? আশা করি আগামী দিনে উপযুক্ত শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়ে আবার সুপথে ফিরতে পারবে ছাত্রটি।
তমাল মুখোপাধ্যায়, ডানকুনি, হুগলি
উপযুক্ত তদারকি
‘প্রকল্পে নয়, পড়াশোনার খোঁজেই নজর রাখতে চান স্কুল পরিদর্শকেরা’ (২৮-১০) সংবাদ প্রসঙ্গে কিছু কথা তুলে ধরতে চাই। সরকার-পোষিত বা অনুমোদিত বিদ্যালয়ে প্রকল্প থেকে পড়াশোনা— সব কিছুতেই নজরদারির প্রয়োজন আছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত রাজ্যে নানা স্তরের মোট স্কুলের সংখ্যা ৬৩,৯০১, যার মধ্যে প্রায় তিন হাজার স্কুল উচ্চ প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে এবং মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উন্নীত হয়েছে গত এক দশকের মধ্যে। সব মিলিয়ে হাজার খানেক বিদ্যালয় পরিদর্শক এই বিপুল সংখ্যক স্কুল পরিদর্শন করে উঠতে পারবেন না, এমনটাই স্বাভাবিক। হিসাব করলে দেখা যায়, এক এক জন পরিদর্শক বছরে ৬০টি স্কুলে যেতে পারলে, সব মিলিয়ে বার্ষিক ৬০,০০০ স্কুল পরিদর্শন করা সম্ভব হবে।
যাতায়াতের খরচ অপ্রতুল বলে স্কুলে যাওয়া যদি সম্ভব না হয়, তবে দফতরের কাছাকাছি স্কুলগুলিতে পরিদর্শকরা যাবেন, এ-টুকু আশা করাই যায়। স্কুলে সরকারি পরিদর্শনের প্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে কি? অনেকেই বলবেন ‘না’, যে-হেতু ২০১৮ সালের পর থেকে বিদ্যালয় পরিদর্শনের খরচ দেওয়া অনিয়মিত হয়েছে। এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এমন প্রশ্নও ওঠে, নিয়মিত এই বরাদ্দ মঞ্জুরির সময়কালেও বিদ্যালয় পরিদর্শন কি ততটা নিয়মিত ছিল? অভিজ্ঞতা কিন্তু সে কথা স্বীকার করে না।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে ইংরেজি (দ্বিতীয় ভাষা) শিক্ষার জন্য পাঠ্যপুস্তক ‘বাটারফ্লাই’-এর পাশাপাশি ‘উইংস’ নামে একটি ওয়ার্ক বুক দেওয়া হয়। ষষ্ঠ শ্রেণিতেও এমন ইংরেজি ওয়ার্ক বুক দেওয়া হয়, যার নাম ‘ফ্র্যাগরান্স’। ছাত্রছাত্রীদের কাজ করানোর পর এই বইগুলির প্রতিটি পৃষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষিকা, বিদ্যালয় প্রধানের পাশাপাশি বিদ্যালয় পরিদর্শকের স্বাক্ষর করার জায়গা রাখা রয়েছে। কিন্তু এই বইগুলি গ্রাম-বাংলা থেকে শহরে কতখানি অবহেলার সঙ্গে ব্যবহৃত হয়, শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত যে কেউ তা বলতে পারবেন।
পূর্বের ‘সর্বশিক্ষা মিশন’-এর যুগ শেষ হয়ে এখন ‘সমগ্র শিক্ষা মিশন’-এর যুগ চলছে। বিভিন্ন জেলায় এই প্রকল্পের শীর্ষ আধিকারিক পদে বিদ্যালয় পরিদর্শকদের না নিয়ে রাজ্য সিভিল সার্ভিস থেকে নেওয়া হচ্ছে। যদিও পঠনপাঠনের প্রশিক্ষণ তাঁদের চাকরির শর্ত নয়। সহ-শিক্ষামূলক নানা কর্মসূচি তাই গয়ংগচ্ছ ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সাধারণ মানের ছেলেমেয়েদের কাছে পড়াশোনা আনন্দপাঠ হয়ে উঠতে পারছে না। উৎসাহ দানের অভাবে কেন্দ্রীয় স্তরের আয়োজিত নানা প্রতিযোগিতা-কর্মসূচির খবর ছাত্রছাত্রীদের অধিকাংশের কাছেই পৌঁছতে পারছে না। সম্প্রতি ভারতীয় ডাক বিভাগ ‘ঢাই অক্ষর’ নামে চিঠি লেখার যে কর্মসূচি নিয়েছে, বাৎসরিক পরীক্ষার অজুহাতে অনেক পড়ুয়ার কাছেই সে খবর পৌঁছয়নি।
গ্রামাঞ্চলে এখনও বিকল্প না থাকার কারণে সরকার-পোষিত বিদ্যালয়েই ছাত্রছাত্রীদের যেতে হচ্ছে। আর, শহর-শহরতলির অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হচ্ছে। প্রশ্ন হল, উন্নয়নের সদিচ্ছাটুকু এ ক্ষেত্রে আছে কি? ব্রিটিশ-ধাঁচের পরিদর্শন বা ইনস্পেকশনের যুগ আর নেই। রাজ্যের স্কুল-শিক্ষা বাঁচাতে এখন আর পরিদর্শকের তির্যকদৃষ্টি নয়, সহযোগিতা ও সহানুভূতিশীল ব্যবস্থাপকদের প্রয়োজন। এই সহযোগিতামূলক তদারকি লেখাপড়ায় উন্নত নানা দেশ আগেই অবলম্বন করেছে। পঠনপাঠন বা প্রকল্প রূপায়ণ— একে অপরের পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, এ কথা অনুধাবন করাতে পেশাদারি প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সকলকে।
অনুশ্রী গুড়িয়া, কলকাতা-৮৪