West Bengal Ration Distribution Case

‘এটা নাকি গরিব রাজ্য?’ শঙ্করের লেনদেন শুনে আদালতে বিস্মিত বিচারক, ১৪ দিন ইডি হেফাজতে

বনগাঁয় ধৃত শঙ্কর আঢ্যের লেনদেনের হিসাব শনিবার ব্যাঙ্কশাল আদালতে দিয়েছে ইডি। কেন্দ্রীয় সংস্থার দাবি, বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশি মুদ্রায় বদলে দুবাইতে পাঠানো হয়েছে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:০১
Judge was shocked to hear transaction details of Shankar Adhya by ED

রেশন ‘দুর্নীতি’তে ধৃত শঙ্কর আঢ্য। —ফাইল চিত্র।

রেশন ‘দুর্নীতি’কাণ্ডে বনগাঁর প্রাক্তন পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্যকে গ্রেফতার করেছে ইডি। শুক্রবার রাতে তাঁকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ে স্থানীয় অনুগামীদের বিক্ষোভের মুখেও পড়তে হয় কেন্দ্রীয় সংস্থাকে। শনিবার আদালতে সেই শঙ্কর ওরফে ‘ডাকু’র বিপুল টাকা লেনদেনের হিসাব দিয়েছে ইডি। যা শুনে বিচারকও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। শঙ্করকে ১৪ দিনের ইডি হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

Advertisement

শুক্রবার সকালে রেশনকাণ্ডের তদন্তে শঙ্করের বনগাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন ইডি আধিকারিকেরা। সঙ্গে ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। তাঁর শ্বশুরবাড়িতেও অভিযান চলে। রাতে যখন শঙ্করকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছিল ইডি, কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখানো হয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী লাঠি নিয়ে তেড়ে যায় বিক্ষোভকারীদের দিকে। এমনকি, ইডির গাড়ি লক্ষ্য করে ইটও ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। বনগাঁর ঘটনাতে আইনি পদক্ষেপ করতে পারে ইডি। সেই তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গিয়েছে বলে খবর সূত্র মারফত। এর আগে শুক্রবারই সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখের বাড়িতে গিয়ে অনুরূপ বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল ইডি আধিকারিকদের। শাহজাহানের দেখা পায়নি ইডি। উল্টে তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে মার খেয়েছেন কেন্দ্রীয় আধিকারিকেরা। জনতার মারে ইডির তিন আধিকারিক এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এক জনের মাথায় ছ’টি সেলাইও পড়েছে।

শনিবার আদালতে শঙ্করের বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচার ব্যবসার হিসাব দেখিয়েছে ইডি। তাদের দাবি, ৯০টি ফরেক্স সংস্থার মাধ্যমে অন্তত ২০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে লেনদেন করা হয়েছে। টাকা গিয়েছে দুবাইতে। কখনও সরাসরি, কখনও বাংলাদেশ মারফত দুবাইতে ওই টাকা পৌঁছেছে বলে ইডি বিচারককে জানিয়েছে। ইডির দাবি, ওই টাকার মধ্যে ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা রেশন ‘দুর্নীতি’কাণ্ডে ধৃত রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের। ইডির হিসাব শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে বিচারক বলেন, ‘‘এত টাকার লেনদেন, আর বলা হচ্ছে এটা নাকি গরিব রাজ্য!’’

বনগাঁয় ‘সন্দেশখালি মডেল’

শুক্রবার রাতে বনগাঁয় ‘সন্দেশখালি মডেল’ দেখা যায়। তৃণমূল নেতা শাহজাহানের বাড়ির সামনে ইডিকে যে ভাবে বাধা দেওয়া হয়েছিল, একই ভাবে বনগাঁতেও কেন্দ্রীয় সংস্থাকে আটকানোর চেষ্টা করা হয়। সন্দেশখালিতে জনতার হাতে মার খেয়েছে ইডি। তিন আধিকারিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ইডির বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ রাজ্যের শাসকদলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। সন্দেশখালি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে ‘সহযোগিতা’র পথে হাঁটা হবে? না কি এই ‘সন্দেশখালি মডেল’কেই ভবিষ্যতের পথ হিসাবে দেখবে তৃণমূল? চলছে জল্পনা।

আইনি পদক্ষেপের পথে ইডি

বনগাঁয় বাধা পেয়ে আইনি পদক্ষেপের পথে হাঁটতে চাইছে ইডি। শুক্রবার রাতে শঙ্করকে গ্রেফতার করে গাড়িতে তোলার সময়ে তাঁর অনুগামীরা ইডিকে বাধা দেয় বলে অভিযোগ। ইডির গাড়ির সামনে তাঁরা বিক্ষোভ দেখান। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যেতে দেখা যায় তাঁদের দিকে। কয়েক জন লাঠির বাড়িও খান বলে অভিযোগ। বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে রাস্তা ফাঁকা করার পরেই এগোতে পারে শঙ্করকে নিয়ে যাওয়া ইডির গাড়ি। এই ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ করতে পারে কেন্দ্রীয় সংস্থা। স্থানীয় থানায় দায়ের করা হতে পারে অভিযোগও। ইডি সূত্রে খবর, সেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই।

ইডি হেফাজতে ডাকু

ডাকুকে শনিবার ১৪ দিনের ইডি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। ১৪ দিন পর আবার তাঁকে আদালতে হাজির করানো হবে। আগামী ১৪ দিনে রেশন সংক্রান্ত বিভিন্ন খুঁটিনাটি তাঁর কাছ থেকে জানার এবং তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা চালাবে কেন্দ্রীয় সংস্থা।

ডলারে লেনদেন

ইডি আদালতে জানিয়েছে, বিদেশি মুদ্রায় টাকার লেনদেন করতেন বনগাঁর শঙ্কর। লেনদেন হত মূলত ডলারেই। ভারতীয় টাকা ডলারে পরিণত করে তা বিদেশি অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হত। বিপুল লেনদেনের কথা জানতে পেরেছেন তদন্তকারী আধিকারিকেরা।

আদালতে হিসাব ইডির

ইডির দাবি, শঙ্কর ২০ হাজার কোটি টাকা ডলারে বদলে বিদেশে পাঠিয়েছেন। তার মধ্যে ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা মন্ত্রী বালুর। গত ১০ বছর ধরে এই দুর্নীতি চলছে বলে জানিয়েছে ইডি।

চিঠি চালাচালি

ইডি আদালতে জানিয়েছে, ধৃত মন্ত্রী বালুর সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে হাসপাতালে যোগাযোগ রেখেছিলেন শঙ্কর। বালুর কন্যার মাধ্যমে চিঠি চালাচালি হয়েছিল। মেয়ের হাতে চিঠি তুলে দিয়েছিলেন কোদ মন্ত্রী। সেই চিঠি ইডি হাতে পেয়েছে। তাতে একাধিক নাম রয়েছে বলেও জানায় কেন্দ্রীয় সংস্থা। বাংলা এবং ইংরেজি মিশিয়ে লেখা ছিল সেই চিঠি। ১৯ ডিসেম্বর জ্যোতিপ্রিয়কে জেরা করা হয় যখন, তখন তিনি সেই চিঠির কথা স্বীকার করেন। ওই চিঠিতে টাকা পাচারের কথা লেখা রয়েছে। ইডি আরও দাবি করেছে, কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে ১৬ ডিসেম্বর জ্যোতিপ্রিয়ের ঘর থেকে সিসি ক্যামেরা খোলা হচ্ছিল। সেই সময় ওই চিঠি মেয়েকে দিচ্ছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। সেই চিঠি ধরে ফেলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্যেরা। হাসপাতালে জ্যোতিপ্রিয়ের নিরাপত্তায় যে সিআরপিএফ জওয়ানেরা বহাল ছিলেন, তাঁদের মাধ্যমেই ইডির হাতে চিঠিটি এসেছে।

কী বলেছিলেন শঙ্করের স্ত্রী

শুক্রবার রাতে শঙ্করের গ্রেফতারির পর তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না আঢ্য জানিয়েছিলেন, ইডি মারফত তিনি জেনেছেন, জ্যোতিপ্রিয়ের সূত্র ধরেই তাঁর স্বামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘শুক্রবার রাত ১২টা ১৫ মিনিটে এক জন অফিসার এলেন। এসে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কাগজ দেখালেন। বললেন, জ্যোতিপ্রিয় আপনার নাম বলেছে। বা কেউ বলেছে। সে জন্য গ্রেফতার করল।’’ এর পরেই জ্যোৎস্না জানিয়েছেন, সারা দিন শঙ্করের সঙ্গে ব্যবসার বিষয়ে ইডি অফিসারেরা কথা বললেও জ্যোতিপ্রিয় নিয়ে কোনও কথা বলেননি। সব রকম সহযোগিতার পরেও রাত সাড়ে ১২টার সময় গ্রেফতার করা হয় তাঁর স্বামীকে। জ্যোৎস্না বলেন, ‘‘জ্যোতিপ্রিয় জেলার সভাপতি ছিলেন। সকলের কাছেই আসতেন। আমরাও যেতাম। এখন দেখছি নাটক। সারা দিন সহযোগিতা করলাম। শেষে এক জন অফিসার ব্যাগ থেকে কাগজ বার করে দেখালেন এবং বললেন জ্যোতিপ্রিয়ের জন্য গ্রেফতার করলাম।’’

কী বললেন ‘ডাকু’র আইনজীবী

আদালতে ইডির তোলা অভিযোগের প্রেক্ষিতে শঙ্করের আইনজীবী জানান, তাঁর মক্কেল ফরেক্স বা বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচার বৈধ ব্যবসা করেন। এই ব্যবসা বেআইনি নয়। তাঁদের দাবি, যথাযথ নিয়ম মেনেই কাজ করা হয়। তার উপযুক্ত নথিপত্র রয়েছে। তাঁর দাবি, গোটা প্রক্রিয়ার উপর ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নজরদারি থাকে। যদিও রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে কখনও কোনও গোলমালের অভিযোগ ওঠেনি বলেই জানিয়েছেন ওই আইনজীবী।

আরও পড়ুন
Advertisement