Naushad Siddiqui

লোকসভায় আইএসএফের নজরে অন্তত ১২টি আসন, ‘দ্বিমুখী কৌশলে’ এগোতে চাইছেন ভাইজান নওশাদরা

২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন থেকে রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের পক্ষে। ক্রমে তা তাদের ‘পুঁজি’তে পরিণত হয়েছে বলে অভিমত অনেকের। তবে সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফল বঙ্গ রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।

Advertisement
শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৩ ০৯:০৫
Naushad Siddiqui

সংখ্যালঘু ও আদিবাসী অধ্যুষিত আসনগুলিতেই নজর নওশাদদের। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।

অতি সম্প্রতি ইমাম-মোয়াজ্জেমদের সম্মেলন মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আমি চাই না ফুরফুরা শরিফ রাজনীতিতে প্রবেশ করুক। যেমন চাই না, বেলুড় মঠ রাজনীতিতে আসুক।’’ কিন্তু ফুরফুরার পিরজাদারা ইতিমধ্যেই লোকসভা ভোটকে লক্ষ্য ধরে রাজনৈতিক অঙ্ক কষা শুরু করে দিয়েছেন।

Advertisement

রাজ্যের একমাত্র আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি নিজে ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা। তাঁর দল আইএসএফ ইতিমধ্যেই লোকসভার লক্ষ্যে আসন ধরে ধরে কৌশল তৈরি করা শুরু করে দিয়েছে। একটি সূত্রের খবর, রাজ্যে ১২টির বেশি লোকসভা আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন নওশাদেরা। শুধু তা-ই নয়, ওই আসনগুলির মধ্যে একাধিক আসনে ফুরফুরা শরিফের পিরজাদারাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলেও দাবি করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ নিজে ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে জানিয়েছেন, তাঁর দল অনুমোদন করলে তিনি অভিষেক বন্দ্যেপাধ্যায়ের কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবার থেকে লোকসভা ভোটে লড়তে চান।

ডায়মন্ড হারবার ছাড়া আর কোন কোন আসনে লড়বেন বলে প্রাথমিক ভাবে ঠিক করেছেন নওশাদরা?

প্রাথমিক ভাবে যা জানা যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ওই তালিকায় রয়েছে শ্রীরামপুর, উলুবেড়িয়া, বারাসত, বসিরহাট, মুর্শিদাবাদের তিনটি আসন, মালদহের দু’টি আসন এবং রায়গঞ্জ। এই সব আসনগুলিতে হয় সংখ্যালঘুরাই গরিষ্ঠ নতুবা তাঁরা ‘নিয়ন্ত্রক’। তবে শুধুমাত্র সংখ্যালঘু এলাকাতেই নয়, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রামের মতো আদিবাসী অধ্যুষিত আসনগুলিতেও প্রার্থী দিতে পারে আইএসএফ। যদিও এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে নওশাদ কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘এ নিয়ে আমি এখন কিছু বলব না।’’ তবে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হল, ভাঙড়ের বিধায়ক ওই প্রসঙ্গে এখন কিছু বলতে না চাইলেও সরাসরি বিষয়টি নাকচও করেননি। ‘এখন’ বলছেন না বলে যে পরে বলবেন না, তেমনও নয়।

২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকে রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোট মমতার দিকেই ঝুঁকে রয়েছে। ক্রমে তা শাসকদলের ‘পুঁজি’তে পরিণত হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। কিন্তু সাগরদিঘি উপনির্বাচনে তৃণমূলের হার এবং বামেদের সমর্থনে কংগ্রেস প্রার্থী বাইরন বিশ্বাসের জয় বাংলার রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সংখ্যালঘু ভোটের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে নানা স্তরে আলোচনা এবং জল্পনা শুরু হয়েছিল। সাগরদিঘির ‘ধাক্কা’ সামলাতে প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক স্তরে ঝাঁকুনি দিতে চেয়েছিলেন মমতা। উদ্দেশ্য ছিল সংখ্যালঘুদের ‘বার্তা’ দেওয়া। সেই প্রেক্ষিতে নওশাদদের এক ডজনের বেশি লোকসভা আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা তৃণমূলের জন্য কতটা দুশ্চিন্তার হতে পারে? শাসকদলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ অবশ্য বলছেন, ‘‘নওশাদরা ক’টা আসনে প্রার্থী দেবেন, সেই বিষয়টা তাঁদের হাতে নেই। গোটাটাই বিজেপি ঠিক করে দেবে। লোকসভা ভোট মানে দেশ থেকে বিজেপিকে বিদায় দেওয়ার ভোট। সেখানে সংখ্যালঘুরা কখনওই বিজেপির ‘বি টিম’ আইএসএফকে ভোট দেবেন না। ফলে আমাদের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।’’

প্রসঙ্গত, মমতা নিজে কখনও আইএসএফ বা নওশাদের নাম নেন না। কখনও বলেন, ‘বিজেপির দালাল’, কখনও বলেন, ‘হায়দরাবাদের পার্টিটার (আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দল ‘মিম’) মতো ভোটকাটুয়া’। ঘটনাচক্রে, মঙ্গলবার নবান্ন সভাঘরে প্রস্তাবিত ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ নিয়ে সর্বদল বৈঠকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যদিও তাদের এক জন বিধায়ক রয়েছেন। অথচ সিপিএম, কংগ্রেস, এসইউসি, সিপিআই (এম এল) লিবারেশনের মতো রাজ্যে যে দলগুলির কোনও বিধায়ক নেই, তাদেরও ডাকা হয়েছিল। সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভাকেও। কিন্তু ডাকা হয়নি নওশাদকে। অনেকে মনে করছেন, সংখ্যালঘুদের বার্তা দিতেই কৌশলে ভাইজানকে আমন্ত্রণ না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা।

এখন থেকেই আইএসএফের লোকসভা আসনওয়াড়ি পরিকল্পনার মধ্যে ‘দ্বিমুখী কৌশল’ রয়েছে বলেই অনেকের অভিমত। প্রথমত, সংখ্যালঘু প্রশ্নে তৃণমূলকে ‘চাপে’ রাখা। দ্বিতীয়ত, সিপিএম এবং কংগ্রেসকে বার্তা দেওয়া। সিপিএম কত আসন আইএসএফকে ছাড়বে, সেটা যেমন এখনও স্পষ্ট নয়, তেমনই অধীর চৌধুরীর বহরমপুর এবং আবু হাসেম (ডালু) খান চৌধুরীর মালদহ দক্ষিণে প্রার্থী দিয়ে আইএসএফ কিয়দংশ সংখ্যালঘু ভোট কেটে নিলে তা কংগ্রেসের জন্য ‘বিড়ম্বনাজনক’ হবে। একটি অভিমত হল, শাসক তৃণমূলের পাশাপাশি বিরোধী সিপিএম-কংগ্রেসকে আগে থেকে চাপে রাখতেই এই কৌশল নিচ্ছেন নওশাদেরা।

পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল দেখে আইএসএফ নেতৃত্ব মনে করছেন, তাঁরা এখন কেবল ‘ভাঙড়ের পার্টি’ নন। রাজ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে তাঁদের বিস্তার ঘটেছে। এক আইএসএফ নেতার কথায়, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের সন্ত্রাস এবং ভোট লুটের পরেও আমাদের ভোট অভাবনীয় হারে বেড়েছে। লোকসভায় মানুষ ভোট দিতে পারলে ফল অন্য রকম হবে।’’ যদিও পাশাপাশিই তিনি এটাও মেনে নিচ্ছেন যে, পঞ্চায়েত ভোট আর লোকসভা ভোটের প্রেক্ষাপট কখনওই এক নয়। তা হবেও না। কিন্তু লোকসভা নিয়ে আইএসএফ যে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে, তা তাদের কর্মপদ্ধতিতে স্পষ্ট। শেষ পর্যন্ত নওশাদেরা লোকসভা ভোটে ক’টি আসনে প্রার্থী দেবেন, তা সময় বলবে। তবে তেমন কিছু হলে রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোটের সমীকরণে বদল হবে কি না, হলেও কোথায় কত বদল হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন স্তরে কৌতূহল রয়েছে।

আরও পড়ুন
Advertisement