Baro Ghari of Howrah Station

অনেক অপেক্ষা দেখেছে হাওড়ার ‘বড় ঘড়ি’, নিজেই আজ শতবর্ষের অপেক্ষায়, দুই মুখে তবু সুখ নেই

হাওড়া স্টেশনের ‘বড় ঘড়ি’। একটা সময় ছিল অপেক্ষার অপর নাম। দিনবদলে দিন গিয়েছে তার। তবে কেউ অপেক্ষা করুক না করুক নীরবে দুই মুখে সব দেখে সে।

Advertisement
নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৩ ২১:৩৮
Baro Ghari of Howrah Station

বড় ঘড়ির দুই মুখ। নিজস্ব চিত্র।

অপেক্ষা। ছোট্ট শব্দটার মধ্যে সুতোয় গাঁথা মালার মতো জড়িয়ে থাকে অনেক শব্দ। অনেক কথা। পথে চেয়ে থাকার নামই তো অপেক্ষা। অপেক্ষাই ভালবাসার কঠিনতম শর্ত। অনেকে বলেন, অপেক্ষার পথের শেষেই বাস মিলনের।

৯৭টা বছর ধরে এমন অনেক অপেক্ষাই দেখেছে হাওড়ার ‘বড় ঘড়ি’। তার দুটো মুখ। এক মুখে ডান দিকে দেখে পূর্ব রেলের আসা যাওয়া। বাম মুখ দক্ষিণ-পূর্বের দিকে। তবে দু’মুখো নয় মোটেই। কথাই যে বলে না। শুধু দেখে। কত জন তার নীচে এসে মিলেছে। কত জন ‘কেউ আসবে বলে’ অপেক্ষায় থেকে থেকে চলে গিয়েছে। কেউ রোজ রোজ এসেছে, ‘যদি সে আসে’ ভেবে।

Advertisement

দুই চোখ, দুই হাত এক হওয়ার মিলনই নয়, অনেকের এক হওয়াও অনেক দেখেছে হাওড়ার ‘বড় ঘড়ি’। পাঁশকুড়া থেকে আসবে রুদ্রদেব আর সৈকত। ও দিকে পান্ডুয়া থেকে রওনা দিয়েছে উজ্জ্বল, সনৎ। কবে থেকেই তো কথা হয়ে রয়েছে, দেখা হবে ‘বড় ঘড়ি’র তলায়। তার পরে বাক্সপ্যাঁটরা, বেডিং নিয়ে জগন্নাথ এক্সপ্রেস। পুরী।

এখনকার মোবাইল সর্বস্ব সময়ে এমন কথা ভাবাই মুশকিল। তাই তো ‘বড় ঘড়ি’র দুই মুখে সুখ নেই। অপেক্ষার অপর নাম ‘বড় ঘড়ি’ হলেও তার অপেক্ষা আর কে করে! সবাই সবাইকে ফোনে ডেকে নেয়। ভিড়ে হারিয়ে যাওয়াকে ‘লোকেশন’ খুঁজে দেয়। ‘বড় ঘড়ি’ হয় তো ভাবে, অপেক্ষাই কি তবে শেষ হয়ে গেল! সেও যে পুরনো দিনের লোক। জানবে কী করে যে, এখন অপেক্ষা থাকে মেসেজে ব্লুটিক হওয়ার, রিপ্লাই আসার। অপেক্ষা থাকে চাওয়া নম্বরটা স্ক্রিনে ভেসে ওঠার। এখন ‘বড় ঘড়ি’-র অবস্থাটা অনেকটা চিঠির মতো।

‘বড় ঘড়ি’ অবশ্য অন্য অনেক কিছু দেখেছে। সে একটা সময় ছিল। শোনা যায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত প্রেম করতে যেতেন লোকাল ট্রেনে চেপে। প্রেমিকা মীনাক্ষী স্ত্রী হওয়ার আগে অফিস শেষে এখানেই দেখা করতেন কবির সঙ্গে। দেখা হলেই ট্রেনে চেপে যে কোনও স্টেশন। ফেরা আবার হাওড়া স্টেশনে। বাংলার গল্পে, উপন্যাসে ‘বড় ঘড়ি’ অনেক বার চরিত্র হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাসে চার শহুরে যুবককে অরণ্যে পাঠানোর আগে এখানেই মিলিয়েছিলেন। ‘বড় ঘড়ি’র তলায় দেখা করেই ওঁরা ট্রেন ধরেছিলেন। তার পরে আচমকা নেমে পড়েছিলেন ধলভূমগড় স্টেশনে।

‘বড় ঘড়ি’ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী প্রায় শতবর্ষ ধরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে দুই জার্মানি এক হয়ে যাওয়া, ভারত ভাগ থেকে মোদী-মমতা অনেক কিছুই। স্টিম ইঞ্জিনের সময় থেকে এখন হাওড়া স্টেশনের নীচে পাতাল পথে গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতায় যাওয়া মেট্রো রেল। তার নিজের ইতিহাসও তো কম নয়। লন্ডনের এডওয়ার্ড জন ডেন্টের সংস্থার তৈরি ঘড়িটি হাওড়া স্টেশনে জায়গা পায় ১৯২৬ সালে। একই সংস্থা তৈরি করেছিল লন্ডনের বিগ বেন। ফলে ওরা একই বংশের। ৩ ফুট ৯ ইঞ্চির ডায়ালে বড়া কাঁটা দু’ফুটের। আর ছোট কাঁটাও ছোট নয় মোটেও। লম্বায় দেড় ফুট। প্রথমে মেকানিক্যাল ঘড়ি ছিল। ১৯৭৫ সালে ‘বড় ঘড়ি’ ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল হয়। এখন অবশ্য রিচার্জেব্‌ল ব্যাটারিচালিত স্বয়ংক্রিয় ঘড়ি হয়ে গিয়েছে। লন্ডনে জন্ম হলেও হাওড়া স্টেশনে লাগানোর দায়িত্ব পেয়েছিল কলকাতার বিখ্যাত ঘড়ি ব্যবসায়ী দেবপ্রসাদ রায়ের সংস্থা রায় ব্রাদার্স কোম্পানি।

তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। তবু এখনও সময় মেপে সময় জানিয়ে যান ‘বড় ঘড়ি’। হেরিটেজ ঘড়িকে এত দিন সচল রাখার কৃতিত্ব দাবি করতেই পারে পূর্ব রেল। আজও বড় ঘড়ি ডান মুখে ১ থেকে ৮ আর বাঁ মুখে ৯ থেকে ১৫ নম্বর প্লাটফর্মের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। কাঠের বেদীতে বসা ঘড়িটার ‘টিক টিক’ শব্দ নীচ থেকে শোনা না গেলেও হৃদস্পন্দন থামেনি।

‘বড় ঘড়ি’র তলায় আজও হয় তো কেউ কেউ অপেক্ষা করে। কেউ এসে হাত ধরে। কেউ আবার অপেক্ষাতেই থেকে যায়। কে জানে, কোনও বাবা আর সন্তানকে দাঁড় করিয়ে রেখে টিকিট কাটতে যান কি না? তবে ‘বড় ঘড়ি’ সে সব ভাবার অপেক্ষা করে না। বয়েই গেছে তার।

টেস্ট, ওয়ান ডে থেকে টি-টোয়েন্টি দেখা ৯৭-এ নট আউট ‘বড় ঘড়ি’ এখন আপাতত সেঞ্চুরির অপেক্ষায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement