অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ফেসবুক।
এ বার ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের প্রস্তুতিপর্বে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনও ভূমিকা চাক্ষুষ করা যায়নি। যা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে কৌতূহলের শেষ ছিল না। সেই অভিষেক রবিবারের মঞ্চে এসেছেন। ২৫ মিনিট বক্তৃতাও করেছেন। তাতে যা বলেছেন, তার পর তৃণমূলের মধ্যে আর কোনও ‘কৌতূহল’ নেই। নেই ‘সংশয়’ও। শাসকদলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই মনে করছেন, অভিষেক আবার দলীয় সংগঠন ফের নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। এর পরে তৃণমূল সাংগঠনিক সংস্কারের পথেও হাঁটবে, তা-ও নিজের বক্তৃতায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন সেনাপতি।
অভিষেক জানিয়েছেন, গত দেড়মাসে তিনি ভোটের ফলাফল ‘পর্যালোচনা’ করেছেন। সেই বিশ্লেষণের যা ফল তিনি দেখেছেন, তার অভিঘাত আগামী তিন মাসের মধ্যে সকলে তার ফল দেখতে পাবেন। যা থেকে স্পষ্ট যে, দলীয় সংগঠনে অভিষেক ‘পুরস্কার এবং তিরস্কার’-এর নীতি কঠোর ভাবে প্রণয়ন করতে চাইছেন। এবং তা দলের সর্বোচ্চ নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অনুমোদন’ সাপেক্ষেই। যা থেকে দলের অধিকাংশ নেতা মনে করছেন, ‘ছোট বিরতি’ কাটিয়ে অভিষেক আবার সংগঠনের ‘মূলস্রোতে’ ফিরে এসেছেন।
বিভিন্ন সময়ে অভিষেক-মমতার ‘দূরত্ব’ নিয়ে তৃণমূলের মধ্যে তো বটেই, সার্বিক ভাবে বাংলার রাজনীতিতেও আলোচনা হয়েছে। যা শুরু হয়েছিল দলের অন্দরে ‘নবীন-প্রবীণ’ বিতর্ক দিয়ে। অভিষেক বলেছিলেন, তিনি মনে করেন, সব পেশার মতো রাজনীতিতেও বয়সের ঊর্ধ্বসীমা থাকা উচিত। মমতা অভিষেকের উল্টো অবস্থান নিয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি মনে করেন না বয়স কোনও সূচক। বলেছিলেন, ‘‘মনের বয়সটাই আসল।’’ তা নিয়ে তৃণমূলে নবীন-প্রবীণ কোন্দল প্রকাশ্যে এসে পড়েছিল। রবিবার কিন্তু সেই অভিষেকই বলেছেন, ‘‘প্রবীণদের অভিজ্ঞতা এবং নবীনদের উদ্যমের সামঞ্জস্য রেখেই দল চলবে।’’ তৃণমূলের অনেকে মনে করছেন, অভিষেক যা বলেছেন, তা নেত্রীর সঙ্গে ‘সমন্বয়’ রেখেই বলেছেন। এক দিকে তিনিও ‘বয়সবিধি’ নিয়ে কিছুটা নমনীয় হয়েছেন। অন্যদিকে, নেত্রীও তাঁকে সাংগঠনিক সংস্কার করার জন্য প্রয়োজনীয় ‘অনুমোদন’ দিয়েছেন। যা অভিষেক আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেছেন সমাবেশে।
রবিবার ধর্মতলার সমাবেশে অভিষেক বলেছেন, ‘‘যে পুরসভা এবং পঞ্চায়েত এলাকায় লোকসভা ভোটে তৃণমূল পিছিয়ে রয়েছে, সেখানে পুরসভার চেয়ারম্যান, শহর তৃণমূলের সভাপতি, পঞ্চায়েত প্রধান এবং অঞ্চল সভাপতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে দল।’’ তাঁর যুক্তি, পঞ্চায়েত বা পুরসভা ভোটে তাঁরা যে পরিশ্রম করেন, লোকসভা বা বিধানসভায় তা করেন না। সময় বেঁধে দিয়ে অভিষেক জানিয়েছেন, এই অংশের বিরুদ্ধে তিনি পদক্ষেপ করবেন তিন মাসের মধ্যে। অভিষেক-ঘনিষ্ঠদের অনেকেই এই বিষয়টিকে ‘বড়’ করে দেখতে চাইছেন। তাঁদের মূলত দু’টি ব্যাখ্যা রয়েছে। প্রথমত, হারা এলাকায় অভিষেক কেবল পুরসভার চেয়ারম্যানের কথা বলেননি। শহর তৃণমূলের সভাপতির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থার কথা বলেছেন। একই ভাবে গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েত প্রধান এবং অঞ্চল সভাপতির কথাও বলেছেন। অর্থাৎ, প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা নেতাদের কথা একই সঙ্গে বলেছেন। যা থেকে বোঝা যাচ্ছে, সংগঠন এবং প্রশাসন যে সমান্তরাল ভাবে চলে, অভিষেক সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন। যা অনেক ক্ষেত্রেই নেই। দ্বিতীয়ত, অভিষেকের বার্তা যে ভাবে সংগঠনে আলোড়ন ফেলেছে, একই ভাবে তা প্রশাসনেও আঁচ ফেলবে। ক্রমশ তা স্পষ্ট হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
কৌতূহলের বিষয় হল, পুরসভার চেয়ারম্যান-শহর তৃণমূলের সভাপতি বা পঞ্চায়েত প্রধান-অঞ্চল সভাপতি— কেন এই দুই অংশকে একই বন্ধনীতে রেখেছেন অভিষেক? তৃণমূল নেতৃত্বের অনেকের বক্তব্য, লোকসভা ভোটে অনেক জায়গায় ‘অন্তর্ঘাত’ হয়েছে। কোথাও তা পুরপ্রধান করেছেন, কোথাও সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা নেতারা করেছেন। অভিষেক সেই সংস্কৃতিটাই ভাঙতে চাইছেন। অভিষেক-ঘনিষ্ঠ এক তরুণ নেতার বক্তব্য, ‘‘তিন মাসের মধ্যে যদি ৫০-৫৫টি পুরসভায় চেয়ারম্যান, কয়েকশো গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা নেতাদের রদবল হয়, তা হলে গোটা পার্টিতে থরহরিকম্প শুরু হয়ে যাবে। তার পরে নতুন যাঁরা আসবেন, তাঁরা দলাদলি করতে গেলে দু’বার ভাববেন।’’
গত ১২ জুন অভিষেক তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে জানিয়েছিলেন, তিনি চিকিৎসার জন্য সংগঠন থেকে ‘ছোট বিরতি’ নিচ্ছেন। তা নিয়ে শাসকদলে কম আলোচনা হয়নি। অভিষেকের ঘনিষ্ঠেরাই ঘরোয়া আলোচনায় বলেছিলেন, একাধিক বিষয়ে সেনাপতি ‘বিরক্ত’। তার মধ্যে অন্যতম সরকারের বিভিন্ন দফতরের কাজে ‘শ্লথতা’। বেশ কিছু মন্ত্রী এবং আমলার কাজ নিয়েও অভিষেকের ‘অসন্তোষ’ রয়েছে বলে ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য। রবিবারের সভা থেকে অভিষেক জানিয়েছেন, তিনি এই দেড় মাস লোকসভার ফলাফলের পর্যালোচনা করেছেন। তার যা নির্যাস তার ভিত্তিতেই হারা এলাকায় প্রশাসন ও সংগঠনের দায়িত্বে থাকা নেতাদের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থার’ কথা বলেছেন তিনি। এবং এ-ও বলেছেন, ‘‘আমি এক কথার ছেলে। যা বলি তা-ই করি। দেড় মাস ধরে যে পর্যালোচনা করেছি, তিন মাসে তার ফল দেখতে পাবেন।’’ যা শুনে তৃণমূলের অনেকেই বলছেন, আগামী তিন মাসে দলের ‘খোলনলচে’ বদলে যেতে পারে। পাশাপাশি, প্রশাসনিক কাজেও ‘গতি’ আসবে। এই প্রসঙ্গে ২০২২ সালের ২১ জুলাইয়ের সমাবশে অভিষেকের বলা একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে তৃণমূলের প্রথম সারির এক নেতা বলেন, ‘‘এ বার আক্ষরিক অর্থেই ‘নতুন তৃণমূল’ দেখা যাবে। যা হবে গতিশীল। সংগঠন এবং প্রশাসন হবে পরস্পরের পরিপূরক।’’ ভোটে দেওয়া প্রতিশ্রুতিমাফিক আবাস যোজনার বাড়ির টাকা যেন পৌঁছে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে জুনের ওই ‘এক্স’ পোস্টে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে আর্জি জানিয়েছিলেন অভিষেক। রবিবার অভিষেক তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তা হয়ে যাবে।
অভিষেকের রবিবারের বক্তৃতাকে যেমন তৃণমূলের অনেকে সংগঠনের মূলস্রোতে তাঁর ‘ফিরে আসা’ হিসাবে দেখতে চাইছেন, তেমনই বিরোধীরা কটাক্ষ করেছে। বিজেপির মুখপাত্র রাজর্ষি লাহিড়ীর বক্তব্য, ‘‘ওঁদের চেয়ারম্যান, পঞ্চায়েত প্রধান ইত্যাদি বদল হলে তা হবে দেনাপাওনার শতাংশের গোলমালের জন্য। এর সঙ্গে সংগঠনের কোনও সম্পর্ক নেই। আসলে সবটাই বখরার বিষয়।’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীরও বক্তব্য, ‘‘পুরসভা এবং পঞ্চায়েতে ভোট হয় না। সেখানে যে ভাবে হোক তৃণমূল জিততে চায়। কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েতের নেতারা সেই সাহস পান উপরের তলার নেতাদের কারণেই। আসলে তৃণমূলের মাথারাই লুটের রাজনীতির হোতা।’’