CPM Party Congress

বাংলার চার জেলা সম্পাদক সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিতে! ‘ব্যতিক্রমী’ ঘটনায় আবারও প্রকট নতুন নেতৃত্বের সঙ্কট

সরকারে থাকার পর্বে রাজ্য সিপিএম একটা সময় পর্যন্ত নেতৃত্বে নতুনদের তুলে আনলেও পরে তা থমকে গিয়েছিল। যা দলে প্রজন্মের ফাঁক তৈরি করেছে। সেই ফাঁক পূরণ করতে এখন সিপিএম যে ভাবে বয়সবিধি কার্যকর করছে, তা কোথাও কোথাও যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে বলেও অভিমত অনেকের।

Advertisement
শোভন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:০০
Despite the generational shift in the Party Congress of CPM, the crisis of leadership in West Bengal is exposed

প্রজন্ম বদলের পার্টি কংগ্রেসই প্রকট করল বঙ্গ সিপিএমের নেতৃত্বের সঙ্কট। — প্রতীকী চিত্র।

৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে আন্দোলনহীন হয়ে যাওয়ার পরিণতি? না কি ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার ফল? কারণ যা-ই হোক, বাংলার সিপিএমের অভ্যন্তরে নতুন নেতৃত্ব উঠে না-আসার সঙ্কট নানা স্তরেই এখন আলোচিত বিষয়। নতুন করে দলকে উঠে দাঁড়াতে হলে এই সমস্যার মোকাবিলা না-করে হবে না। সেই সঙ্কটের ছবিটা আরও এক বার প্রকট হল সদ্যসমাপ্ত পার্টি কংগ্রেসের শেষে দলের শীর্ষ-কমিটি গঠনের সময়।

Advertisement

সিপিএমের মাদুরাই কংগ্রেস থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হলেন ৮৫ জন। তাঁদের মধ্যে ৩১ জন নতুন মুখ। বাংলা থেকে নতুন অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন পাঁচ জন। তাঁদের মধ্যে তিন জন দলের জেলা সম্পাদকের দায়িত্বে। আর এক জন আগেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন, কিন্তু তিনিও বিগত সম্মেলন প্রক্রিয়ায় নতুন জেলা সম্পাদক হয়েছেন। সব মিলিয়ে, একসঙ্গে চার জন জেলা সম্পাদককে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেওয়া সিপিএমের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

দেবলীনা হেমব্রম আগেই কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁকে তিন মাস আগে বাঁকুড়ার জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছে দল। নতুন অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে দেবব্রত ঘোষ হুগলির জেলা সম্পাদক, সৈয়দ হোসেন পূর্ব বর্ধমানের এবং সমন পাঠক দার্জিলিংয়ের জেলা সম্পাদক পদে রয়েছেন। এঁরা প্রত্যেকেই রাজ্য কমিটির সদস্য (দেবলীনা এবং দেবব্রত রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীরও)। সিপিএমের দলীয় সংবিধান অনুযায়ী এক ব্যক্তি একই সঙ্গে তিনটি স্তরে থাকতে পারেন না। থাকতে হলে ‘বিশেষ অনুমোদন’ লাগে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশেষ অনুমোদন তখনই প্রয়োজন হয় যখন ‘ব্যতিক্রমী’ পরিস্থিতি তৈরি হয়।

Despite the generational shift in the Party Congress of CPM, the crisis of leadership in West Bengal is exposed

(বাঁ দিক থেকে) দেবলীনা হেমব্রম, দেবব্রত ঘোষ, সৈয়দ হোসেন, সমন পাঠক। —ফাইল চিত্র।

অতীতে কি এমন নজির নেই বঙ্গ সিপিএমে? রয়েছে। তবে এক জন-দু’জনের ক্ষেত্রে হয়েছে। একসঙ্গে চার জন— নজিরবিহীনই। ২০১১ সালে সিপিএম সরকার থেকে চলে যাওয়ার পরে উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক করা হয়েছিল প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেবকে। গৌতম তার অনেক আগে থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। সেই সময়ে উত্তর ২৪ পরগনার পাঁচ গোষ্ঠীর কোন্দল রুখতে আলিমুদ্দিন গৌতমকে সেই বিশেষ দায়িত্বে দিয়েছিল। গত মেয়াদে দীর্ঘ সময় কেন্দ্রীয় কমিটি এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে থাকার পাশাপাশি দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক ছিলেন শমীক লাহিড়ী এবং নদিয়ার জেলা সম্পাদক ছিলেন সুমিত দে। শমীককে যদিও মধ্য মেয়াদে দলের প্রভাতী মুখপত্রের সম্পাদকের ভার দিয়ে জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছিল। কিন্তু সুমিত ছিলেন সম্মেলন পর্যন্ত। এমন ব্যতিক্রম সিপিএমে ছিল।

কিন্তু অতীতে একসঙ্গে চার জনকে ‘ব্যতিক্রমী’ ভাবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিতে হয়নি কেন? কারণ, একটা প্রজন্ম পর্যন্ত সিপিএমে নেতার অভাব ছিল না। অবিভক্ত বর্ধমানের জেলা সম্পাদক যখন অমল হালদার, তখন বর্ধমান থেকেই সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন নিরুপম সেন, বিনয় কোঙার, মদন ঘোষ। তাঁরা জেলার দল পরিচালনা করতেন উপর থেকে। জেলায় থেকে নয়। হাওড়ায় যখন দীপক দাশগুপ্ত জেলা সম্পাদক, তখন কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পলিটব্যুরোয় ছিলেন চিত্তব্রত মজুমদার। আবার দীপক যখন কেন্দ্রীয় কমিটিতে, তখন হাওড়ায় সম্পাদক পদে শ্রীদীপ ভট্টাচার্য (যাঁকে এ বার পলিটব্যুরোতে নিল সিপিএম)।

এমন উদাহরণ অসংখ্য। কৌতূহলের বিষয় হল, মাদুরাই পার্টি কংগ্রেস থেকে ফিরে এসে কি এই চার জন জেলা সম্পাদক পদ ছেড়ে দেবেন? এখনই সে ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সেই সুযোগ নেই বলেই অভিমত সিপিএমের অনেকের। কেন? তাঁদের যুক্তি, বাকি তিন জন না-হয় পার্টি কংগ্রেস থেকে প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হলেন। কিন্তু দেবলীনা বাঁকুড়ার জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য থাকা অবস্থায়। সিপিএম নেতারা অনেকেই ঘনিষ্ঠ কথাবার্তায় মানছেন, দায়িত্ব বিকেন্দ্রীকরণের জন্য যে সংখ্যায় যোগ্য নেতা-নেত্রী প্রয়োজন, তা পাওয়া যাচ্ছে না।

সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনের রিপোর্টেই উল্লেখ ছিল, বহু জায়গায় অনেক তরুণ সদস্য শাখা সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছেন। আবার এই বঙ্গ সিপিএমেই বহু এরিয়া কমিটি, জেলা কমিটিতে নেতা হওয়ার জন্য ভোটাভুটিতে রাত গড়িয়েছে। কোথাও কোথাও মারামারি পর্যন্ত হয়েছে। যা নিয়ে আবার তদন্ত কমিশন পর্যন্ত গঠন করতে হয়েছে দলকে। সিপিএমের এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘একেবারে নিচুতলায় পার্টির দায়িত্ব না-নেওয়ার মানসিকতা এবং উপরতলায় নেতা হওয়ার ঝোঁক যখন সমান্তরাল ভাবে দেখা যায়, তখন বুঝতে হবে অবক্ষয় গভীরে পৌঁছেছে।’’

যদিও সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম মানতে চাননি যে, চার জেলা সম্পাদককে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা বাংলায় দলের নেতৃত্ব-সঙ্কট। তাঁর কথায়, ‘‘সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই এই সিদ্ধান্ত। দীর্ঘ মেয়াদে তাঁরা যাতে কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকতে পারেন, পরবর্তী নেতৃত্ব তুলে আনতে পারেন, সেই কারণেই এটা করা হয়েছে।’’ সেলিম নিজে রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আগ্রাসী ভাবে নতুনদের নেতৃত্বে তুলে আনার চেষ্টা করে চলেছেন। তাঁদের় দু’-এক জনের ক্ষেত্রে ‘বিচ্যুতি’ ধরা পড়ছে ঠিকই, কিন্তু এক-আধ জন ‘মিনাক্ষী’ও তৈরি হচ্ছেন। তবে একান্ত আলোচনায় সিপিএমের অনেক নেতাই মানছেন, সার্বিক ভাবে দলে একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে। সেই ফাঁক প্রজন্মের। যা সাংগঠনিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।

সরকারে থাকার পর্বে রাজ্য সিপিএম একটা সময় পর্যন্ত নেতৃত্বে নতুনদের তুলে আনলেও পরে তা থমকে গিয়েছিল। সেটাই দলে প্রজন্মের ফাঁক তৈরি করেছে বলে অনেকের মত। সেই ফাঁক পূরণ করতে এখন সিপিএম যে ভাবে বয়সবিধি কার্যকর করছে, তা কোথাও কোথাও যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে বলেও অভিমত অনেকের। তাঁদের মতে, বিধি আর বাস্তব যে এই মুহূর্তে বহু ক্ষেত্রেই বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে, তা চার জেলা সম্পাদককে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করার ঘটনাতেও স্পষ্ট।

সন্দেহ নেই যে, মাদুরাই পার্টি কংগ্রেসে সিপিএমের পলিটব্যুরোয় প্রজন্ম বদল ঘটে গিয়েছে। বয়সের কারণে বিদায়ী পলিটব্যুরোর সদস্যদের মধ্যে সাত জনের বাদ পড়ার কথা ছিল। সেই তালিকায় ছিলেন প্রকাশ কারাট, বৃন্দা কারাট, সুভাষিনী আলি, কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন, ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, বাংলার সূর্যকান্ত মিশ্র এবং তামিলনাড়ুর জি রামকৃষ্ণন। ‘ব্যতিক্রম’ হিসাবে বিজয়নকে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পলিটব্যুরোয় রেখে দেওয়া হলেও বাকি ছ’জন সরে গিয়েছেন নেতৃত্ব থেকে। তাঁদের জায়গায় এসেছেন নতুনেরা। সেই প্রজন্ম বদলের পার্টি কংগ্রেসই প্রকট করল বঙ্গ সিপিএমের নেতৃত্বের সঙ্কট। তা তত দিন প্রকট থাকবে, যত দিন-না দায়িত্ব নেওয়ার মতো নতুন উপযুক্ত লোক মেলে। সেটা সহজ নয়, মোক্ষম বুঝছেন সিপিএমের প্রবীণ নেতারা।

Advertisement
আরও পড়ুন