দক্ষিণ ২৪ পরগনায় নেতা অনেক, কিন্তু লোক নেই বুথে। —প্রতীকী ছবি।
সন্ন্যাসী অনেক। কিন্তু তাতে ভোটের গাজন নষ্টই হয়েছে।
শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্মেলন। সেই সম্মেলনের সম্পাদকীয় খসড়া প্রতিবেদনে (যা আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে রয়েছে) যা যা লেখা হয়েছে, তাতে বুথ স্তরে দলের ‘সাংগঠনিক দুর্বলতা’ শুধু যে বেআব্রু হয়ে গিয়েছে তা-ই নয়, দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এই দল কি আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? গত সম্মেলন থেকে এই সম্মেলন পর্যন্ত ‘বড়’ ভোট বলতে হয়েছে ২০২৪ সালের লোকসভা। সেই নির্বাচনের যে পরিসংখ্যান খসড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট যে, নেতার আধিক্য থাকলেই সংগঠন মজবুত হয় না।
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিতে দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে রয়েছেন সুজন চক্রবর্তী এবং শমীক লাহিড়ী। দু’জন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীরও সদস্য। ঘটনাচক্রে, দু’জনেই বেশ কয়েক বছর করে জেলা সম্পাদকেরও দায়িত্বে ছিলেন। সিপিএমের দৈনিক প্রভাতী মুখপত্রের সম্পাদক হওয়ায় কয়েক মাস হল শমীক জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব ছেড়েছেন। অন্তর্বর্তী সময়ে জেলা সম্পাদক হয়েছেন রতন বাগচী। তিনিই সম্পাদকীয় প্রতিবেদনটি পেশ করেছেন। এ ছাড়া এই জেলা থেকে রাজ্য কমিটিতে রয়েছেন রাহুল ঘোষ, তুষার ঘোষ, প্রতিক-উর রহমানেরা। এত নেতা থাকলেও প্রতিবেদন বলছে, বুথ স্তরেই লুকিয়ে আছে ‘দুর্বলতার ভূত’। নেতার আধিক্য দিয়ে তা কাটানো যায়নি।
ডায়মন্ড সিস্টেম
ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্র দক্ষিণ ২৪ পরগনার মধ্যে পড়ে। যে কেন্দ্র থেকে এ বার দেশের মধ্যে সর্বাধিক ভোটে জিতেছেন তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ডায়মন্ড হারবারে ১,৯৬১টি বুথ রয়েছে। সিপিএম তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, তার মধ্যে ৬২৮টি বুথে এজেন্ট ছিল না! সেখানেই শেষ নয়। প্রতিবেদনের ৫৬ পাতার শুরুতেই লেখা হয়েছে, ডায়মন্ড হারবারে ১১৬২টি বুথে ‘১৭-সি ফর্ম’ (প্রতিটি দলের এজেন্ট ভোটের শেষে এই ফর্ম প্রিসাইডিং অফিসারকে দিয়ে সই করিয়ে দলে জমা দেন। যাতে নির্বাচন কমিশনে নথিভুক্ত থাকে, কোন দলের এজেন্ট ছিলেন বা ছিলেন না) পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, শুধু যে ৬২৮টি বুথে এজেন্ট দেওয়া যায়নি তা নয়। আরও ৫০০-র বেশি বুথে এজেন্ট দিলেও তাঁরা শেষ পর্যন্ত বুথে ছিলেন না। যদিও এ প্রসঙ্গে সিপিএম সন্ত্রাসের অভিযোগ করেছে। তবে দলেরই একটা অংশ বলতে শুরু করেছে, ‘‘লোকে নাকে কান্না শুনতে চায় না। আমরা দুর্বলতা ঢাকতে নাকে কেঁদেই চলেছি!’’ ডায়মন্ডে অভিষেকের বিরুদ্ধে সিপিএমের প্রার্থী ছিলেন ছাত্রনেতা প্রতিক-উর। তিনি ৬ শতাংশ ভোটও পাননি।
মথুরাপুর
মথুরাপুরেও ছবি প্রায় একই। তবে ডায়মন্ড হারবারের চেয়ে কিছুটা ভাল। এই লোকসভায় ১,৮৯৮টি বুথ। সিপিএম এজেন্ট দিতে পারেনি ৩৩০টি বুথে। ‘১৭-সি’ ফর্ম জমা পড়েনি ৩৪৫টি বুথে। মথুরাপুরে সিপিএমের কপালে জুটেছে ৪.৮০ শতাংশ ভোট। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই ‘ক্ষয়িষ্ণু’ অবস্থাতেও দেখা যাচ্ছে যে, সিপিএমের বিভিন্ন এরিয়া কমিটিতে ভোটাভুটি হচ্ছে। যাকে নেতৃত্বের একটি অংশ ‘ইতিবাচক’ হিসাবে দেখলেও অনেকে বলছেন, সরকারি ক্ষমতায় থাকার মানসিকতা থেকেই একটি অংশ দলীয় কমিটি দখল করে ভিন্ন ়স্বাদের ক্ষমতা উপভোগ করতে চাইছে।
যাদবপুর
একদা ‘বামদুর্গ’ ছিল যাদবপুর। সেখানে সিপিএম তৃতীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। লোকসভা ভোটে তরুণ নেতা সৃজন ভট্টাচার্যকে ওই আসনে দাঁড় করিয়ে সিপিএম প্রচারের আলো কাড়তে পারলেও ভোট যে টানতে পারেনি, তা স্পষ্ট। যদিও দক্ষিণ ২৪ পরগনার চারটি লোকসভার মধ্যে যাদবপুরেই সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে সিপিএম— ১৬.৫২ শতাংশ। তবে প্রার্থীর জামানত রক্ষা হয়নি। যাদবপুরেও বুথে বুথে সিপিএমের ‘দৈন্যদশা’ প্রকট দলীয় প্রতিবেদনে। যাদবপুরে মোট বুথ ২,১২০টি। তার মধ্যে ১২৭টি বুথে এজেন্ট দিতে পারেনি সিপিএম। ২৮৫টি বুথের ‘১৭-সি’ ফর্ম জমা পড়েনি দলের কাছে।
জয়নগরের মোয়া
এই কেন্দ্রে সিপিএমের প্রতীকে প্রার্থী ছিলেন না। বাম শরিক আরএসপি প্রার্থী দিয়েছিল। যদিও সাংগঠনিক ভাবে ভোট করিয়েছিল সিপিএমই। সেই জয়নগরে বাম প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ২.৭১ শতাংশ। ওই লোকসভায় মোট বুথ ১,৮৭৯টি। কিন্তু কত বুথে এজেন্ট ছিলেন বা ছিলেন না, সেই সংক্রান্ত কোনও তথ্য জেলা সিপিএম নেতৃত্ব জানেন না বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। যা শুনে এক তরুণ নেতা রসিকতা করে বলেছেন, ‘‘জয়নগরে মোয়া আছে ঠিক কথা। কিন্তু আমাদের পার্টিটা নেই!’’
আইএসএফ
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে গজিয়ে ওঠা আইএসএফের সঙ্গে বামেদের জোট হলেও ২০২৪ সালের লোকসভায় তা হয়নি। ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি নিজে বলেছিলেন, তিনি ডায়মন্ড হারবারে দাঁড়াতে চান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। নওশাদ বলেছিলেন, ‘‘আমি চাইলেও দল অনুমতি দিচ্ছে না। আমি দলের ঊর্ধ্বে নই।’’ বোঝাপড়ার চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। বরং জেলার সব আসনেই আইএসএফ একক ভাবে প্রার্থী দিয়েছিল। যার ফলে জয়নগর এবং মথুরাপুরে বাম প্রার্থী চলে গিয়েছেন চতুর্থ স্থানে। এ জন্য প্রতিবেদনে আইএসএফের ‘অনড়’ মনোভাবকেই দায়ী করা হয়েছে। যা শুনে নওশাদ পাল্টা বলেছেন, ‘‘আমরা কোনও অনড় মনোভাব দেখাইনি। কমতে কমতে আমরা পাঁচটা আসনে গিয়ে থেমেছিলাম। কিন্তু বামেরাই দু’টির বেশি আসন ছাড়তে চায়নি।’’
প্রতিবেদনে এ-ও লেখা হয়েছে যে, জেলার একটি অংশের কর্মীরা মনে করছেন, বিজেপির বিরোধী হিসেবে মানুষ তৃণমূলকেই বেছে নিয়েছেন। যে মনোভাব থেকে স্পষ্ট, আলিমুদ্দিন যে লাইনে তৃণমূল এবং বিজেপিকে ‘এক’ করে দেখানোর চেষ্টা করে চলেছে, তা গ্রহণ করছেন না দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি অংশের দলীয় সদস্যেরাই।