(বাঁ দিক থেকে) প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা, মহুয়া মৈত্র, স্বাতী মালিওয়াল, কঙ্গনা রানাউত। —ফাইল ছবি।
নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, তিনি ফকির। যে কোনও পরিস্থিতিতে ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়তে পারেন। তৃতীয় বার দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ফলে এখনও পর্যন্ত মোদীকে ঝোলা নিয়ে বার হতে হয়নি। কিন্তু তাঁর তৃতীয় মেয়াদের সরকারের প্রথম শীতকালীন অধিবেশনে সেই ঝোলা হয়ে উঠেছে সংসদে অন্যতম আলোচনার বিষয়। হয়ে উঠেছে রাজনীতির বিষয়ও বটে। সৌজন্যে কংগ্রেসের নতুন সাংসদ প্রিয়ঙ্কা গান্ধী।
পর পর দু’দিন ‘প্যালেস্তাইন’ এবং ‘বাংলাদেশ’ লেখা দু’টি ব্যাগ নিয়ে অধিবেশনে যোগ দিয়ে আলোচিত হয়েছেন ওয়েনাড়ের সাংসদ প্রিয়ঙ্কা। আবার সেই প্রিয়ঙ্কাকেই পাল্টা ব্যাগ ‘উপহার’ পেতে হয়েছে। দিয়েছেন ভুবনেশ্বরের বিজেপি সাংসদ অপরাজিতা সারেঙ্গি। সাদা রঙের সেই ব্যাগে লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ার ছবি। মাঝখানে লেখা ‘১৯৮৪’। অর্থাৎ, ১৯৮৪ সালে প্রিয়ঙ্কার ঠাকুমা ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দুই শিখ নিরাপত্তারক্ষীর গুলিতে নিহত হওয়ার পরে দিল্লির অলিগলিতে শিখ নিধনের স্মৃতির অভিজ্ঞান। যে দাঙ্গায় জড়িত এবং অভিযুক্ত ছিলেন একাধিক কংগ্রেস নেতা।
প্রিয়ঙ্কা কাঁধে ঝোলানো ‘টোট ব্যাগ’ নিয়ে সংসদে গিয়েছিলেন। প্রথম দিন ছিল প্যালেস্তাইনের প্রতি সংহতি। দ্বিতীয় দিন বাংলাদেশ। দু’দেশেই সংখ্যালঘুদের উপর ধারাবাহিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের মারফত ‘সংহতির বার্তা’ দিতে চেয়েছিলেন গান্ধী পরিবারের নবীনতম সাংসদ। ব্যাগের ভিতর কী ছিল, তা জানা যায়নি (মহিলাদের ব্যাগে কী আছে, তা জানার চেষ্টা করা প্রায় ফৌজদারি অপরাধের শামিল বলে গণ্য হয়)। তবে বাইরে যে রাজনীতি ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। যেমন রাজনীতি ছিল প্রিয়ঙ্কার উপহার পাওয়া ব্যাগেও। যে কারণে প্রিয়ঙ্কা প্রথমে সেই ‘উপহার’ নিতেই চাইছিলেন না। পরে অবশ্য নিয়েছেন।
মহিলাদের ‘ভ্যানিটি ব্যাগ’-কে দুষ্টু লোকেরা বলে থাকেন ‘ফুটানি কা ডিব্বা’। তাঁদের বক্তব্য, মহিলারা ভ্যানিটি ব্যাগ মারফত তাঁদের ‘রোয়াব’-এর জানান দেন। কিন্তু কালে কালে সেই ভূমিকার বদল ঘটেছে। মহিলা রাজনীতিকদের অনেকের ব্যাগ যেমন ‘রাজনৈতিক বিবৃতি’ বহন করে, তেমনই অনেক মহিলা সাংসদ বা রাজনীতিকের ঝুলি থেকে ফ্যাশনের বেড়ালও বেরোয়।
অতীতে মহিলা সাংসদদের শাড়ি নিয়ে রাজধানীর রাজনীতিতে বিস্তর আলোচনা ছিল। সেই তালিকায় প্রথম সারিতে নাম ছিল সনিয়া গান্ধী, সুষমা স্বরাজ, অম্বিকা সোনি, জয়ন্তী নটরাজন, বৃন্দা কারাটদের। ইদানীং শাড়িকে স্থানচ্যুত করেছে ব্যাগ। অধুনা মহিলা সাংসদদের ব্যাগ হয়ে উঠেছে তাঁদের ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ অথবা বিতর্কের ঝুলি। যেমন একদা তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের ‘লুই ভিতঁ’র মহার্ঘ ব্যাগ নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলেছিল। তার মধ্যে ‘নেতিবাচক’ মন্তব্যই ছিল বেশি। সেই অর্থে মহুয়াই সাংসদদের মধ্যে প্রথম ‘ব্যাগবতী’ খেতাবের অধিকারিণী।
কিন্তু কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদকে এ বারের শীত অধিবেশনে ছাপিয়ে গিয়েছেন আম আদমি পার্টির সাংসদ স্বাতী মালিওয়াল। মার্কিন সংস্থা ‘কোচ’-এর একটি সাদা হোবো ব্যাগ নিয়ে অধিবেশনে এসেছেন স্বাতী। পরনে গাঢ় নীল শাড়ি। তার উপরে সাদা ফুলস্লিভ জ্যাকেট। পায়ে সাদা নিউকাট। বিজেপির অভিনেত্রী সাংসদ কঙ্গনা রানাউতের হাতে থাকে ‘লুই ভিতোঁ’রই ‘স্যাচেল ব্যাগ’। তৃণমূলের সায়নী ঘোষ নেন ‘মেসেঞ্জার ব্যাগ’। যে ধরনের ব্যাগে ল্যাপটপ বা আইপ্যাড ভরে নেওয়া যায়। তৃণমূলের অভিনেত্রী-সাংসদ জুন মালিয়াও ‘ব্যাগবতী’। তিনি ‘টোট ব্যাগ’ ব্যবহার করেন। সমাজবাদী পার্টির সাংসদ তথা অখিলেশ যাদবের স্ত্রী ডিম্পল যাদব ‘বোটেগা’র টোট ব্যাগ ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। তৃণমূলের শতাব্দী রায় ব্যবহার করেন ‘স্লিং ব্যাগ’। তবে শতাব্দী ব্যাগের থেকে বেশি শৌখিন চশমার ফ্রেমের রং নিয়ে। আজ আকাশি, কাল গোলাপি তো পরশু হলুদ। শাড়ির রঙের সঙ্গে রং মিলিয়ে চশমার ফ্রেম। ‘স্লিং ব্যাগ’ নেন বিজেপির হেমা মালিনীও।
সাংসদদের অধিবেশনে যোগ দিতে গেলে ব্যাগ নিতেই হয়। তাতে নথিপত্র থাকে। অতীতেও সাংসদেরা নিতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাগ যে ভাবে ‘প্রদর্শনের বস্তু’ হয়ে উঠেছে, তা অতীতে ছিল না বলেই অভিমত অনেকের। বিজেপির বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল পেশায় ফ্যাশন ডিজ়াইনার। কাগজপত্র নেওয়ার জন্য তিনি একটি সাধারণ ব্যাগই নেন। ঝোলার ফ্যাশনকে তিনি কী নজরে দেখেন? তাঁর কথায়, ‘‘কারও স্টাইল স্টেটমেন্ট থাকতেই পারে। তার মধ্যে আমি কোনও অন্যায় দেখি না। তবে আমার একটাই প্রশ্ন, জনপ্রতিনিধি হয়ে এ সব করার তাঁরা সময় পান কী করে? আমি তো পাই না!’’
কিন্তু ‘ব্যাগবতী’ (এই শব্দবন্ধটি শোনা গিয়েছিল জোয়া আখতারের ছবি ‘জ়িন্দেগি না মিলেগি দোবারা’ ছবিতে। কল্কি কেঁকলা অভিনীত চরিত্রের বহুমূল্য ব্যাগটিকে ওই নাম দেওয়া হয়েছিল। যে ব্যাগের জন্য গাড়িতে একটি আস্ত আসনও বরাদ্দ থাকত) হওয়ার এই প্রবণতা কেন?
বিভিন্ন দলের একাধিক প্রবীণ সাংসদের বক্তব্য, সমাজমাধ্যম এবং চ্যানেলের ক্যামেরার জন্য। তাঁদের বক্তব্য, সমাজমাধ্যমে দর্শক বাঁধা এবং অগুন্তি। ফলে নিজেকে প্রকট ভাবে বিজ্ঞাপিত করা বা নিজের বিবৃতি ছবির মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া অনেক সহজ। তাই সেই প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। এক প্রবীণ (পুরুষ) সাংসদের কথায়, ‘‘সংসদে ভাষণের চেয়ে এখন সংসদের বাইরের ফ্যাশন অনেক বেশি লোককে আকর্ষণ করে। এটা আরও বাড়বে। আমরা তো জানি যে, পহলে দর্শনধারী। পিছে গুণবিচারী।’’ তবে দ্বিতীয় একটি অভিমতও রয়েছে। যা বলছে, রাজনীতিতে বিত্তশালীদের প্রভাব যে বৃদ্ধি পেয়েছে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বৈভবের প্রদর্শন। অতীতে অনেকে বিত্তশালী হলেও তা আড়াল করতেন। এখন প্রদর্শন করেন। কারণ, মানুষের মনস্তত্ত্ব বদলে গিয়েছে।
অর্থাৎ, সুন্দর ব্যাগের জয় সর্বত্র!