CPM

আয় গোপন করার প্রবণতা বাড়ছে সিপিএমে, ‘ঝোঁক’ বেশি শহরাঞ্চলে, জেনেও নিরুপায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট

প্রতি বছর দলীয় সদস্যপদ পুনর্নবীকরণের সময়ে আয় উল্লেখ করতে হয় সিপিএমের দলীয় সদস্যদের। বছরের গোড়াতেই হয় সেই প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই গোড়াতেই গলদ থেকে যাচ্ছে বলে জানতে পারছেন দলীয় নেতৃত্ব।

Advertisement
শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭
There is a growing tendency among CPM party members to conceal real income

আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে দলের, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির কথা ভেবে পদক্ষেপ করার ক্ষেত্রেও দোদুল্যমানতা নেতৃত্বের। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

দলীয় সদস্যদের মধ্যে বাড়ছে আয় গোপন করার প্রবণতা। এবং সেই ঝোঁক গ্রামাঞ্চলের থেকে বেশি প্রকট শহরাঞ্চলে দলীয় সদস্যদের মধ্যে। সিপিএমের এরিয়া স্তরের সম্মেলন প্রক্রিয়া যখন প্রায় গুটিয়ে এসেছে, তখন এই ‘ছদ্ম আয়’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে দলের মধ্যে। জানুয়ারি মাস থেকে সিপিএমের সদস্যদের পদের পুনর্নবীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। তার মধ্যেই চলবে জেলা সম্মেলনের কাজ। কিন্তু এরিয়া স্তরের সম্মেলনের নির্যাস নিয়ে একান্ত আলোচনায় দলের প্রথম সারির নেতারা মানছেন, দলের রোজগেরে সদস্যদের একটি অংশ ‘সঠিক আয়’ দলে নথিভুক্ত করছেন না।

Advertisement

যদিও সব বুঝেও ‘নিরুপায়’ সিপিএম নেতৃত্ব। দলের প্রথম সারির নেতাদের অনেকের বক্তব্য, কড়াকড়ি করতে গেলে অনেকের খাতার নাম কাটিয়ে দিয়ে সদস্যপদ ছাড়িয়ে দিতে হবে। এই ‘দুর্দিনে’ সেটা সর্বত্র করা যাচ্ছে না বলেও ঘনিষ্ঠবৃত্তের আলোচনায় স্বীকার করে নিচ্ছেন সিপিএম নেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য, এমনিতেই ভোট নেই। এখন ‘কঠোর’ হলে সাংগঠনিক কাঠামো টিকিয়ে রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়বে। পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতার জন্যই এ ব্যাপারে ‘আপস’।

সিপিএমের কর্মীদের একটি পরিচিত ‘লব্জ’ রয়েছে, ‘‘আমরা টাকা দিয়ে পার্টি করি, টাকা নিয়ে নয়।’’ যার অর্থ, সিপিএমের সদস্যরা দলকে টাকা দেন। দলের কাছ থেকে টাকা নেন না। দলের গঠনতন্ত্রেই উল্লেখ রয়েছে, সিপিএমের সদস্য হতে গেলে নির্দিষ্ট আয়ের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট শতাংশ হারে চাঁদা দিতে হবে দলকে। যাকে দলীয় পরিভাষায় বলা হয় ‘লেভি’। যেমন যাঁদের আয় হাজার টাকার কম, তাঁদের মাসে এক টাকা দিতে হয়। আবার এক হাজার এক টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত যাঁদের আয়, তাঁদের মাসিক লেভির হার আয়ের ০.৫ শতাংশ। বেশি টাকা রোজগার যাঁদের, তাঁদের লেভির হারও বেশি। যেমন, যাঁদের মাসিক আয় ২০ হাজার ১ টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা, তাঁদের লেভির হার আয়ের ২ শতাংশ। ৩০ হাজার এক টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকা যাঁদের মাসিক রোজগার, তাঁদের লেভির হার ২.৫ শতাংশ। আবার ৮০ হাজার টাকার বেশি যাঁদের মাসিক রোজগার, তাঁদের লেভির হার সর্বোচ্চ— ৪ শতাংশ।

প্রতি বছর দলীয় সদস্যপদ পুনর্নবীকরণের সময়ে আয় উল্লেখ করতে হয় সিপিএমের দলীয় সদস্যদের। বছরের গোড়াতেই হয় সেই প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই গোড়াতেই গলদ থেকে যাচ্ছে বলে জানতে পারছেন দলীয় নেতৃত্ব। বিশেষত, বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত বা পেশায় ব্যবসায়ী দলীয় সদস্যদের মধ্যে আয় গোপন করার প্রবণতা বেশি। সরকারি চাকুরেদের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা রয়েছে, তবে তা অন্য ভাবে। সিপিএম সূত্রের খবর, যে সব শিক্ষক বা অধ্যাপক দলের সদস্য, তাঁরা বছরের গোড়ায় বেতন গোপন করেন না। কিন্তু তাঁরা প্রাইভেটে টিউশন পড়ালে সেই আয় দলকে জানান না। তবে কিছু কিছু জায়গায় তার ব্যতিক্রমও আছে। কোথাও কোথাও এমনও দলীয় সদস্য রয়েছেন, তাঁরা ‘পে স্লিপ’ দেখিয়ে লেভি প্রদান করেন। আবার বছরের মাঝে বেতন বৃদ্ধি পেলে সেটাও দলকে অবগত করেন এবং বর্ধিত হারে লেভি গ্রহণের আর্জি জানান। তবে তাঁদের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা।

গ্রামাঞ্চলে এই প্রবণতা কম কেন, একান্ত আলোচনায় তার ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন সিপিএম নেতৃত্ব। তাঁদের বক্তব্য, গ্রামাঞ্চলে যিনি ১০০ দিনের কাজ করেন বা ক্ষেতমজুর, তাঁর আয় কম। ফলে তাঁর লেভির হারও কম। তাঁর মাসে ২০ টাকা বা ৩০ টাকা দিতে গায়ে লাগে না। কিন্তু যাঁর বেশি আয়, যাঁকে মাসে ১৫০০ বা ২০০০ টাকা দিতে হবে। সেই অংশই আয় গোপন করছে। তবে এর অন্য দিকও ব্যাখ্যা করছেন সিপিএম নেতৃত্ব। দলের এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘একজন তরুণ হয়তো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনও ছোট কাজ করে মাসিক ১০ হাজার টাকা রোজগার করছেন। সংসার চালাতে সেই তিনিই হয়তো সন্ধ্যা থেকে রাত উবের বা র‌্যাপিডো বাইক চালাচ্ছেন। তাঁর ক্ষেত্রে বিষয়টিকে সহানুভূতির সঙ্গেই দেখতে হবে দলকে। চাপিয়ে দিলে হবে না।’’

সম্ভবত সেই কারণেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলছেন, ‘‘লেভি দেওয়া এবং প্রকৃত আয় পার্টিকে জানানোর ক্ষেত্রে যান্ত্রিক ভাবে কড়াকড়ি করে কিছু হবে না। তার জন্য দরকার পার্টি সম্পর্কে বোধ তৈরি করা। সেটা ধারাবহিক প্রক্রিয়া।’’ সেলিম এ-ও মেনে নিয়েছেন যে, এই বিষয়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে, যা চিহ্নিত করা হয়েছিল ২০১৫ সালে কলকাতা প্লেনামে (সাংগঠনিক সংস্কারের সম্মেলন)। তা কাটানোর জন্য প্রয়াস জারি রয়েছে বলেও দাবি করেছেন সেলিম।

সিপিএম নেতৃত্বের অনেকেরই বক্তব্য, প্রকৃত আয় গোপন করার ফলে দলের ‘ক্যাডারনীতি’তে প্রভাব পড়ছে। তাঁদের ব্যাখ্যা, সরকার থেকে চলে যাওয়ার পরে দলে আর্থিক সঙ্কট বৃদ্ধি পেয়েছে। বহু জেলাই খরচ কাটছাঁট করছে। এমন অনেক জেলা কমিটি আছে, যারা গত পাঁচ-সাত বছরে একাধিক গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক জেলা শুধুমাত্র আর্থিক কারণেই সর্ব ক্ষণের কর্মী (হোলটাইমার) নিয়োগ করতে পারছে না। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘একটি বড় জেলায় যদি ৫০০ জন প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে লেভি কম দেন, তা হলে জেলা কমিটির ক্ষতি হয় আড়াই লক্ষ টাকা। যে টাকা হোলটাইমার নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেত।’’ তবে এর উল্টো দিকও রয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের এক জেলা সম্পাদকের কথায়, ‘‘আমাদের জেলায় এমন অনেক মহিলা পার্টি সদস্য রয়েছেন, যাঁরা রাজ্য সরকারের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প গ্রহণ করেন। তাঁরা অন্য কোনও পেশায় যুক্ত নন। কিন্তু সেই ভাতাকেই আয় হিসেবে নথিভুক্ত করেছেন দলে। তার ভিত্তিতে লেভিও দেন তাঁরা।’’ তাঁর সরস উক্তি, ‘‘মমতার টাকায় আমাদের ভান্ডারে লেভি আসছে।’’ তবে এই সংখ্যা যে নিতান্তই নগণ্য, তা-ও মানছেন প্রায় সকলেই।

Advertisement
আরও পড়ুন