আরজি কর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। —ফাইল চিত্র।
আরজি কর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় ওই মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। তিনি এখন কেন্দ্রীয় সংস্থার হেফাজতে। এর আগে হাসপাতালের আর্থিক দুর্নীতি মামলাতেও নাম জড়িয়েছিল তাঁর। ওই মামলাতেই সন্দীপকে আগে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। পরে ধর্ষণ এবং খুনের মামলাতেও তাঁকে হেফাজতে নেওয়া হয়। আরজি করের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেই হাসপাতালে সন্দীপের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। জুনিয়র ডাক্তারেরা তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। তাঁদের সন্দেহ ছিল, তদন্তপ্রক্রিয়াকে ‘প্রভাবিত’ করতে পারেন সন্দীপ। অর্থাৎ, নিজের হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে যে অধ্যক্ষ হিসাবে সন্দীপ খুব একটা ‘জনপ্রিয়’ ছিলেন না, তা শুরুতেই স্পষ্ট হয়েছিল। কিন্তু অতীত বলছে, কলেজ জীবনেও সহপাঠীদের মধ্যে বিশেষ ‘জনপ্রিয়তা’ ছিল না সন্দীপের। সহপাঠীরা জানাচ্ছেন, কারও সঙ্গেই তাঁর তেমন বনিবনা হত না। মহিলাদের প্রতিও নাকি তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ‘দুর্বল’ ছিলেন কলেজে পড়াকালীন। এখন এমন অপরাধের সঙ্গে সন্দীপের নাম জড়ানোয় বিরক্ত তাঁর প্রাক্তন সহপাঠীদের একাংশ।
১৯৮৯ সালে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ঢুকেছিলেন সন্দীপ। ছ’বছর পর সেখান থেকে ডাক্তারি পাশ করে বেরোন। পরে অধ্যক্ষ হয়ে ওই মেডিক্যাল কলেজেই যান। সন্দীপের সঙ্গে আরজি কর থেকে ওই বছর যাঁরা পাশ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম কৌশিক সাহা। বর্তমানে একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক কৌশিক সন্দীপের নাম শুনেই বললেন, ‘‘ওঁকে বন্ধু বলবেন না! বলুন ব্যাচমেট।’’ সন্দীপকে কলেজ জীবনে পছন্দ করতেন না সহপাঠী তড়িৎ চট্টোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, ‘‘শুধু আমি কেন, ওঁকে কেউই যে তেমন পছন্দ করতেন না, তা ওঁর ডাকনাম শুনলেই বোঝা যায়। কলেজে ওঁকে সবাই বিশেষ ডাকনামে ডাকত। সেই নাম অবশ্য ওঁর পছন্দ ছিল না।’’ সন্দীপের সহপাঠীবৃত্তে খোঁজ নিলে জানা যায়, তাঁকে ‘আলু’ বলে ডাকা হত। কলেজ ছেড়ে যাওয়ার অনেক বছর পরে এক বার বিমানবন্দরে এক সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সন্দীপের। তখন অভ্যাসবশত তাঁকে ওই ডাকনামে বলে ডেকে উঠেছিলেন তিনি। সন্দীপ তা নিয়ে যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন বলে জানান তড়িৎ। এমনকি, পরে ওই সহপাঠীর বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগও করেছিলেন।
প্রাক্তন সহপাঠীরা জানাচ্ছেন, মহিলাদের প্রতি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ‘দুর্বল’ ছিলেন সন্দীপ। তাঁর সেই স্বভাব নিয়েও অনেকে তাঁর উপর বিরক্ত ছিলেন। কলেজ বা হস্টেল, কোথাও সহপাঠীদের ‘বন্ধু’ হয়ে উঠতে পারেননি আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ। সাম্প্রতিক অপরাধে নাম জড়ানোর পর তাঁর উপর প্রাক্তন সহপাঠীদের বিরক্তি আরও বেড়েছে। তড়িৎ বলেন, ‘‘ওঁর উপর আমরা সকলে বিরক্ত ছিলাম। কিন্তু উনি যে এ ভাবে এমন অপরাধের সঙ্গে যে জড়িয়ে পড়বেন ভাবতে পারিনি।’’ ১৯৮৯ সালের আরজি করের সেই ব্যাচের একটি হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে। সেখানেও সন্দীপকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বস্তুত, সন্দীপকে ‘বন্ধু’ বলতে রাজি, এমন কারও খোঁজ পাওয়া দুষ্কর বলে প্রাক্তনীরাই জানিয়েছেন।
আরজি করে সন্দীপরা যে সময় পড়েছেন, নানা কারণে তখনও সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের বিক্ষোভ-আন্দোলন হত। কোনও সময়েই তেমন কোনও আন্দোলনে সন্দীপকে ‘সক্রিয়’ হতে দেখা যায়নি। সন্দীপের প্রাক্তন সহপাঠী চিকিৎসক কৌশিক সাহা বলেন, ‘‘ওকে তো আমরা একপ্রকার বয়কটই করেছিলাম। কখনও কোনও অনুষ্ঠান বা রি ইউনিয়নে ডাকতাম না। কলেজ শেষ হওয়ার পর কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। তবে ও যে অপরাধ জগতের সঙ্গে এ ভাবে জড়িয়ে যাবে, সেটা এখনও ভাবতে পারছি না। এখন ওর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়েছি ভাবতে অস্বস্তিই হচ্ছে।’’
প্রসঙ্গত, আরজি করে অধ্যক্ষ হয়ে যাওয়ার পর সেখানকার প্রাক্তনীদের সংগঠনও কার্যত তুলে দিয়েছিলেন সন্দীপ। প্রাক্তন সহপাঠীদের অভিযোগ, তিনি প্রাক্তনীদের সংগঠনের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটি দখল করে নিয়েছিলেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওই ঘরের কোনও ‘দরকার’ নেই।
সন্দীপের প্রাক্তন সহপাঠী কৌশিক এখন একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। কৌশিক জানান, কলেজ জীবনে সন্দীপ কোনও ক্ষেত্রেই তেমন ‘উল্লেখযোগ্য’ কিছু করেছেন বলে তাঁদের নজরে পড়েনি। সাধারণ মেধার ছাত্র ছিলেন। কখনও তাঁর পরীক্ষার ফল ‘চমকপ্রদ’ ছিল না। পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনও বাড়তি গুণও চোখে পড়েনি। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও তেমন যোগ ছিল না সন্দীপের। কৌশিকের কথায়, ‘‘কলেজের ভোটেও ওকে ডেকে-ডেকে আনতে হত।’’
সেই ‘সাধারণ মেধাসম্পন্ন’ সন্দীপ কী ভাবে পরবর্তী কালে চণ্ডীগড়ের পিজিআইএমইআর থেকে ডিগ্রি লাভ করলেন, কী ভাবে সেখানে তিনি ‘র্যাঙ্ক’ করলেন, তা স্পষ্ট নয় তাঁর প্রাক্তন সহপাঠীদের কাছে। বস্তুত, সাম্প্রতিক অপরাধের সন্দীপের নাম জড়ানোর পর তাঁর ডিগ্রি লাভের ‘প্রক্রিয়া’ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন অনেকে।
আরজি করের অধ্যক্ষ পদে বহাল হওয়ার আগে সন্দীপ কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের (সিএনএমসি) সুপার পদে ছিলেন। প্রাক্তন সহপাঠীদের একাংশের পর্যবেক্ষণ, ওই পদে নিযুক্ত হওয়ার পরে অহঙ্কার বেড়ে গিয়েছিল সন্দীপের। কৌশিক জানান, ন্যাশনাল মেডিক্যালে সন্দীপের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অনেক প্রাক্তন সহপাঠী তাঁর দেখাই পাননি। অনেককে আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখে সামান্য সময়ের জন্য দেখা করেছেন তিনি। কারও সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছেন, এমন উদাহরণও প্রাক্তন সহপাঠীরা দিতে পারছেন না।
সন্দীপকে নিয়ে বলতে গিয়ে প্রাক্তন সহপাঠীরা তাঁর সম্পর্কে ‘অহঙ্কারী’, ‘আত্মকেন্দ্রিক’, ‘স্বার্থপর’ ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করেছেন। তাঁদের সন্দেহ, লেখাপড়ায় ‘গড়পড়তা’ হয়েও তাঁর উত্থান কি ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসেই? প্রশ্ন ঘুরছে প্রাক্তনীদের বৃত্তে।