আমেরিকার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘মেডেল অফ ফ্রিডম’ পেলেন শিল্পপতি জর্জ সোরস। বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাশালী ধনকুবের তিনি। রবিবার সোরস-সহ মোট ১৮ জনকে এই সম্মান তুলে দিয়েছেন আমেরিকার বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
বাইডেনের নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাটিক সরকারের সোরসকে ওই সম্মান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন আমেরিকার হবু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকেরা। সরব হয়েছেন ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ ধনকুবের ইলন মাস্কও।
বহু বিতর্কের কেন্দ্রে থেকেছেন শিল্পপতি সোরস। তবে শুধু আমেরিকায় নয়, আমেরিকার বাইরেও বিতর্কিত চরিত্র তিনি। ট্রাম্পের পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদীরও সমালোচক তিনি।
সোরসের বিরুদ্ধে তাঁর অসরকারি সংগঠন ‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে ‘স্বাধীন কাশ্মীরের ধারণা’কে সমর্থন করার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া বার বার মোদী, বিজেপি সরকার এবং সরকারের একাধিক নীতির সমালোচনা করে শিরোনামে উঠে এসেছেন আমেরিকার এই শিল্পপতি।
২০২০ সালে দাভোসে ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’-এর মঞ্চ থেকে নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে আক্রমণ করেছিলেন সোরস। ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন এবং গণতন্ত্রকে মোদী ‘ধ্বংসের মুখে’ ঠেলে দিচ্ছেন বলে দাবি করেছিলেন সোরস। তিনি বলেছিলেন, “কাশ্মীরের মতো মুসলিম প্রভাবিত অঞ্চলে মোদী সরকারের কঠোর পদক্ষেপ একটা বড় আশঙ্কার বিষয়। হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর তাগিদে দেশের লাখ লাখ মুসলিমকে তাঁদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দিচ্ছেন মোদী।”
ভারত প্রসঙ্গে সোরস আরও বলেছিলেন, ‘‘ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। আদানিদের বিপর্যয়ের ফলে মোদী সরকারের দমননীতি শিথিল হবে এবং সেই প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পথ তরাণ্বিত হবে। আমি হয়তো অনেক কিছুই জানি না, কিন্তু আমি চাই ভারতে একটি গণতান্ত্রিক উত্থান ঘটুক।’’
শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে লগ্নি-গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট নিয়েও সরব হতেও দেখা হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকার ধনকুবের শিল্পপতিকে। ২০২৩ সালে আদানি প্রসঙ্গে মোদীকে নিশানা করে তিনি বলেন, ‘‘আদানি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ার বাজারে যে জালিয়াতির (স্টক ম্যানিপুলেশন) অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং ভারতের সংসদে জবাবদিহি করতে হবে।’’
জার্মানির মিউনিখে নিরাপত্তা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মঞ্চ থেকে সোরস প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মোদী নীরব? তাঁর মত ছিল, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন পরিস্থিতি কাম্য নয়।
যদিও সোরসের মন্তব্যের পর পাল্টা আক্রমণের পথে হেঁটেছিল বিজেপি। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির অভিযোগ ছিল, আদানিকাণ্ড নিয়ে মোদীর উত্তর চেয়ে ‘ভারত-বিরোধী কাজ’ করেছেন আমেরিকার প্রবীণ শিল্পপতি। বিজেপি নেত্রী বলেছিলেন, ‘‘আমি প্রত্যেক ভারতীয়কে জর্জ সোরসকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।’’ সোরসের মন্তব্যে ‘ভারতীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চক্রান্তের’ চিহ্নও খুঁজে পেয়েছিলেন স্মৃতি।
স্মৃতির পর সোরসকে নিশানা করেছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও। আমেরিকার ধনকুবের শিল্পপতিকে ‘বুড়ো, বড়লোক এবং একগুঁয়ে’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন জয়শঙ্কর।
শুধু মোদী নন, সোরসের নিশানায় ছিলেন ট্রাম্পও। প্রথম ট্রাম্প জমানায় তাঁকে ‘প্রতারক’ হিসাবে উল্লেখ করেন সোরস। নিজের স্বার্থ দেখতে গিয়ে ট্রাম্প দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতেও ইতস্তত করেন না বলেও দাবি করেছিলেন সোরস। শুধু তা-ই নয়, ভোটে জেতার জন্য ট্রাম্প যা খুশি করতে পারেন বলেও মন্তব্য করেছিলেন।
সেই সোরসই পেলেন আমেরিকার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান। বাইডেন সরকারের সেই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। সমালোচনা করেছেন ইলন মাস্কও। তাঁর মালিকানাধীন এক্স-এর হ্যান্ডলে পোস্ট করে ইলন লেখেন, ‘‘বাইডেন যে সোরসকে আমেরিকার সর্বোচ্চ সম্মান দিচ্ছেন, তা প্রতারণার শামিল।’’
কে এই সোরস? কী ভাবে তাঁর উত্থান? সোরস হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান শিল্পপতি। ১৯৩০ সালের ১২ অগস্ট তাঁর জন্ম হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে এক ইহুদি পরিবারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি-বিরোধী নীতির মুখে জাল পরিচয়পত্র ব্যবহার করে প্রাণ বাঁচিয়েছিল সোরসের পরিবার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হাঙ্গেরি থেকে সপরিবার লন্ডনে চলে আসেন সোরস। সেখানেই তাঁর পড়াশোনা, উচ্চশিক্ষা। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সে পড়াশোনা শেষ করে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন সোরস। পরে চলে আসেন আমেরিকায়। ষাট এবং সত্তরের দশকে সোরসের কেরিয়ারের গ্রাফ ছিল ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। ‘ডাবল ইগল’, ‘সোরস ফান্ড ম্যানেজমেন্ট’ নামের একের পর এক তহবিল চালু করেন তিনি।
অল্প সময়ের মধ্যে আমেরিকার ইতিহাসে সফলতম ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার হয়ে ওঠেন সোরস। ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে ‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংস্থা চালু করেন তিনি। এই সংস্থা বিশ্ব জুড়ে ১০০টিরও বেশি দেশে সমাজসেবামূলক কাজ করে থাকে।
সোরসের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ব্যক্তিগত সম্পদের ভান্ডার থেকে ৩২০০ কোটি ডলারের বেশি (ভারতীয় মুদ্রায় ২ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকা) অর্থ ‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে জনসেবামূলক কাজে বিলিয়ে দিয়েছেন। ২০২০ সালে ফোর্বসের তরফে তাঁকে ‘উদারতম দাতা’ তকমা দেওয়া হয়।
‘ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংগঠন বা ব্যক্তিগত পরিসরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সামাজিক সমানাধিকার, সাম্য এবং গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে সাহায্য করেন সোরস। সমলিঙ্গ বিবাহ থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকার কালো চামড়ার মানুষদের বৃত্তি— সব ক্ষেত্রেই সোরসের অবদান রয়েছে।
একটি গণতান্ত্রিক সরকারের আওতায় যে সমাজের মানুষ মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেন, যেখানে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার সুরক্ষিত, একমাত্র সেই সমাজেই উন্নয়ন, বিকাশ সম্ভব। এমনটাই মনে করেন সোরস। তাই বিশ্বের নানা প্রান্তে ‘আক্ষরিক অর্থে প্রকৃত গণতন্ত্রের’ পক্ষে স্বর তোলেন তিনি।
বর্তমানে সোরসের বয়স ৯৪ বছর। কিন্তু বয়সের ভারে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রাঙ্গণে তাঁর দাপট নুইয়ে পড়েনি এতটুকু। তাঁর কৌশলকে আজও সমীহ করে চলেন বিশ্বের তাবড় ধনকুবের।
তবে অনেক বিতর্কেও থেকেছেন সোরস। ব্রিটেনে অর্থনীতির অন্যতম কালো অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন তিনি। ১৯৯২ সালে ব্রিটেনের অর্থনীতি ভেঙে ফেলার অন্যতম চক্রী হিসাবে উঠে আসে তাঁর নাম।
সোরস এক হাজার কোটি ডলার অর্থমূল্যের পাউন্ড কিনে অল্প সময়ের মধ্যে তা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে প্রচার করেছিলেন, পাউন্ডের উপর তাঁর ভরসা নেই। এই প্রক্রিয়ায় তিনি প্রায় ১০০ কোটি ডলার লাভ করেছিলেন। সোরসের এই কৌশলে ব্রিটেনে প্রবল অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়।
সোরসের নিন্দকদের অনেকেরই দাবি, শিল্পপতিকে বিভিন্ন জায়গার সরকার ভাঙার কাজে ব্যবহার করে আমেরিকা। তাঁর টাকার জোরকে কাজে লাগিয়ে কার্যসিদ্ধি করা হয়। এ-ও অভিযোগ রয়েছে, সমাজসেবামূলক কাজের নামে ঢুকে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির গভীরে চলে যান সোরস। এর পর নিজেদের সুবিধা মতো সেই সুযোগ কাজে লাগান। একাধিক বার বিভিন্ন দেশে অস্থিরতা তৈরির অভিযোগও উঠেছে সোরসের বিরুদ্ধে।
বিজেপি নেতৃত্ব বার বার সোরসের সঙ্গে কংগ্রেস এবং গান্ধী পরিবারের ‘জোট’ নিয়ে সরব হয়েছেন। বিজেপির দাবি, গোপনে কংগ্রেসকে অর্থসাহায্য করেন সোরস। গান্ধী পরিবারের সঙ্গে সোরসের ‘সুসম্পর্ক’ রয়েছে।
গত ডিসেম্বরে বিজেপি নেতা জেপি নড্ডা রাজ্যসভায় অভিযোগ তুলেছিলেন, ‘‘সোরসের (আমেরিকান ধনকুবের) সঙ্গে গান্ধী পরিবারের সম্পর্ক দেশের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক।’’ সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেণ রিজিজুও দাবি করেছিলেন, ‘‘সোরস এবং সনিয়ার যোগ যথেষ্ট উদ্বেগের।’’
সংবাদ সংস্থা মিডিয়াপার্ট-এর রিপোর্টের ভিত্তিতে বিজেপি অভিযোগ তুলেছিল, জর্জ সোরস ভারতে অস্থিরতা তৈরির জন্য অর্থ খরচ করছেন। কিন্তু মিডিয়াপার্টের পাল্টা দাবি ছিল, বিজেপি রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের রিপোর্ট বিকৃত করছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।