West Bengal Panchayat Election 2023

সুপ্রিম কোর্টেও হারের পর ‘নাম কা ওয়াস্তে’ বাহিনী চাইল কমিশন, হাই কোর্টে কি আবার লড়াই?

কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টের রায় বহাল রেখেছে সু্প্রিম কোর্ট। অর্থাৎ, সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করেই ভোট করতে হবে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২৩ ০১:৫৪
BJP and Congress may go to Calcutta High Court again after State Election Commission wanted 22 Companies of central force for 22 districts

পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে হাই কোর্টের রায় মঙ্গলবার বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।

শেষ হয়েও শেষ হল না পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে রাজ্য সরকার বনাম বিরোধ দলগুলির লড়াই। মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেয়েছে রাজ্য। কিন্তু তার পরেও রাজ্য নির্বাচন কমিশন প্রতি জেলায় মাত্র এক কোম্পানি করে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়ায় আবার কলকাতা হাই কোর্টে যাওয়ার জন্য আঁটঘাঁট বাঁধছে বিজেপি এবং কংগ্রেস। সূত্রের খবর এমনই।

পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে হাই কোর্টের রায় মঙ্গলবার বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতও জানায়, সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে রাজ্যে ভোট করতে হবে। এর আগে হাই কোর্টও ওই নির্দেশ দিয়েছিল। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে শীর্ষ আদালতে গিয়েছিল রাজ্য ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন। মঙ্গলবার সেই মামলার শুনানিতে অবাধ ও স্বচ্ছ ভোটের জন্য হাই কোর্টের নির্দেশই বহাল রাখার কথা জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তার পরেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে ২২ জেলার জন্য ২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন। আর সেখানেই আপত্তি তুলেছেন বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীরা।

Advertisement

এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীতে সাধারণত ১০০ থেকে ১০৫ জন সদস্য থাকেন। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজে লাগানো হয় কম-বেশি ৮০ জনকে। বিরোধীদের দাবি, এটা মোটেই যথেষ্ট নয়। তাই আবার আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। সূত্র মারফত এমনটাই জানা গিয়েছে।

বুধবার আদালত অবমাননার মামলা নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে একটি শুনানি রয়েছে। সেই মামলায় ‘পার্টি’ হিসেবে রয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। মঙ্গলবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিবৃতির পর শুভেন্দুর দাবি, প্রতি জেলায় ১ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। নন্দীগ্রামের বিধায়ক বলেন, ‘‘আদালতের নির্দেশের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ভোটে বুথ, সেক্টর, থানা, স্ট্রং-রুম এবং গণনা কেন্দ্রের দায়িত্বে যৌথ ভাবে থাকবে কেন্দ্রীয় বাহিনী ও রাজ্য পুলিশ। কোনও বাহিনীর বিরুদ্ধেই যাতে অভিযোগ না ওঠে, তাই এই সিদ্ধান্ত। তাই আদালতের নির্দেশ যাতে সঠিক ভাবে প্রয়োগ হয়, সেই দাবিই আমরা হাই কোর্টে জানাব।’’

এর আগে একাধিক বার রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন শুভেন্দু। এমনকি, তিনি এ-ও বলেছেন, কোনও অভিযোগ বা দাবি নিয়ে বর্তমান রাজ্য নির্বাচন কমিশনে যাওয়ার অর্থ হল ফাঁকা রাস্তায় আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করার মতো। শুভেন্দুর দাবি, বিরোধীদের দাবিতে কান দেবে না রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কারণ, তারা রাজ্য সরকারের ‘অঙ্গুলিহেলনে চলে’। অন্য দিকে, বিজেপির মতো কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে যেতে পারে কংগ্রেসও।

রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে তোপ

রাজ্য নির্বাচন কমিশন জেলা প্রতি মাত্র এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়ার পর কটাক্ষ করেছে বিজেপি, কংগ্রেস এবং সিপিএম। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘স্বেচ্ছাচারিতা, দখলদারি এবং নির্লজ্জতার বেনজির দৃষ্টান্ত রাজীব সিংহ। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার জনবিচ্ছিন্ন তৃণমূলকে বাঁচাতে চাইছেন। তবু আমরা বলছি যে, প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে তৃণমূলকে।’’ শমীকের সংযোজন, ‘‘নাম কা ওয়াস্তে কেন্দ্রীয় বাহিনী এনেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনার তৃণমূলকে রক্ষা করতে পারবেন না। আর গোটা বিষয়টাই আদালতের নজরদারিতে হচ্ছে।’’

কংগ্রেস মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায়ের আক্রমণ আরও চড়া। তাঁর কথায়, ‘‘নির্বাচন কমিশনার তো অজুহাত দেখাচ্ছেন। এই নির্বাচন কমিশনার ভোট লুটের একটি এজেন্ট। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে নির্বাচন কমিশন নানা ফন্দিফিকির করে যাচ্ছে। যাতে সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়, তারই যেন চেষ্টা চলছে।’’ সৌম্যের যুক্তি, ‘‘তা না হলে কেন তাঁরা কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে এত টালবাহানা? এমন অনেক জেলা আছে, যেখানে একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ রয়েছে, যেখানে এক কোম্পানি বাহিনী দিয়ে কী হবে?’’ ওই কংগ্রেস নেতার কটাক্ষ, ‘‘কমিশনার চাইছেন, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে হাজারদুয়ারি আর চিড়িয়াখানা দেখার কাজে লাগাবেন। এর মধ্যে তৃণমূলের গুন্ডারা ভোট লুট করবে। বুথে তো বটেই, গণনার দিনেও যাতে ভোট লুট করা যায়, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাই এর পর যদি ভোটকে কেন্দ্র করে কোনও মানুষ মারা যান, তা হলে দায়ী থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী।’’ সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর অভিযোগও একই রকম। কিন্তু বিজেপি এবং কংগ্রেসের মতো সিপিএম যে হেতু কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে আগে আদালতের দ্বারস্থ হয়নি, এ বারও তাঁদের এমন কোনও পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন সুজন।

হাই কোর্টে যা হয়েছিল

আগামী ৮ জুলাই পঞ্চায়েত নির্বাচন। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানোর দাবিতে প্রথম থেকেই সরব বিরোধীরা। পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন-পর্ব ঘিরে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় রক্তপাত, বোমাবাজি, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এই আবহে রাজ্যের সব জেলাতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। গত বৃহস্পতিবার ওই নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে বলা হয়েছিল, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে আবেদন করতে হবে তাদের। প্রথমে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহ জানিয়েছিলেন, আদালতের নির্দেশ মতোই পদক্ষেপ করা হবে। কিন্তু তার পরেই অবস্থান বদল করে কমিশন। হাই কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শনিবার শীর্ষ আদালতে আবেদন করে তারা। ওই দিন শেষ হয় ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমাও। হাই কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে শীর্ষ আদালতে যায় রাজ্য ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন।

সুপ্রিম কোর্ট যা বলল

মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে সংশ্লিষ্ট মামলার শুনানি হয় বিচারপতি বিভি নাগরত্ন এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চে। সুপ্রিম কোর্টে কমিশন জানায়, হাই কোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে, তা কার্যকর করা সম্ভব নয়। মঙ্গলবার শীর্ষ আদালত জানায়, সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করেই রাজ্যে ভোট করতে হবে। বিচারপতি নাগরত্ন বলেন, ‘‘আপনারা (রাজ্য) পাঁচ রাজ্য থেকে পুলিশ চেয়েছেন। আর হাই কোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে বলেছে। খরচ তো কেন্দ্র দেবে। আপনাদের অসুবিধা কোথায়? তা ছাড়া ভোটে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকলে সমস্যা কোথায়?’’ তখন রাজ্যের আইনজীবী রাজ্য পুলিশের উপর সরকারের আস্থার কথা বলেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘রাজ্যের পুলিশ যথেষ্ট সমর্থ। পুলিশকর্মী কম থাকায় অন্য রাজ্য থেকে পুলিশ চাওয়া হয়েছে। সব রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হলে পরিকল্পনা বদল করতে হবে। নির্বাচনের মুখে যা সমস্যার।’’

রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী বলেন, ‘‘নির্বাচন ঘোষণার পরের দিনই মামলা করা হয়। তখন তো মনোনয়ন পর্ব চলছে। মনোনয়ন পর্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মনোনয়ন কেন্দ্রের ১ কিলোমিটার পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। রাজ্যের পুলিশ তাতে সহযোগিতা করেছে।’’ যা শুনে বিচারপতি নাগরত্ন বলেন, ‘‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা আপনাদের উপর নয়, তা হলে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে চিন্তিত কেন? আপনারা আপনাদের কাজ করুন। যেখান থেকেই বাহিনী আসুক, আপনাদের অসুবিধা কোথায়?’’ এর পর কমিশনের আইনজীবী বলেন, ‘‘শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য আমরাও উপযুক্ত নিরাপত্তার দাবি করি। কিন্তু এখানে হাই কোর্ট আমাদের উপর নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইতে। সেটা আমরা কী ভাবে করব? এটা আমাদের কাজ নয়।’’ শেষ পর্যন্ত রাজ্যের ওই যুক্তি গৃহীত হয়নি। হাই কোর্টের রায় বহাল থাকে সুপ্রিম কোর্টে।

কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং পঞ্চায়েত ভোট

২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট রাজ্য পুলিশ দিয়ে হয়েছিল। কিন্তু ভোটে ব্যাপক হিংসার অভিযোগ ওঠে শাসকদলের বিরুদ্ধে। ভোটের আগেই পঞ্চায়েতে ২০ হাজারের বেশি আসনে জয়ী হয় তৃণমূল। পঞ্চায়েতের তিনটি স্তর মিলিয়ে প্রায় ৩৪ শতাংশ আসনে ছিলেন শুধু শাসকদলের প্রার্থী। যা রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটের ইতিহাসে ‘রের্কড’। বিরোধীরা অভিযোগ করে, তাদের মনোনয়ন জমা দিতে দেওয়া হয়নি। কোথাও মনোনয়ন জমা দিলেও তা প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তার উপর ভোটের সময়ও রক্ত ঝরেছে। ওঠে রাজ্য পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোট অবশ্য কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই হয়েছে। সেবার ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিল কমিশন। রাজ্য তাতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত হাই কোর্টের আদালতের নির্দেশে ৮০০ কোম্পানির বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়। সে বার পাঁচ দফার পঞ্চায়েত ভোটে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ির জেলা পরিষদে জয় পেয়েছিল বিরোধীরা।

সুপ্রিম কোর্ট যা বলল

মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নাগরত্ন প্রশ্ন তুলেছেন ভোট নিয়ে রাজ্যের পরিকল্পনা নিয়ে। তিনি বলেন, ‘‘এটা তো অন্য কোনও পরিস্থিতির জন্য নয়, নির্বাচনের জন্য। এটাকে অন্য ভাবে দেখবেন কেন?’’ সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, ‘‘নিরাপত্তা ব্যবস্থা আপনাদের (রাজ্যের) উপর নয়। তা হলে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে চিন্তিত কেন? আপনারা আপনাদের কাজ করুন। যেখান থেকেই বাহিনী আসুক, আপনাদের অসুবিধা কোথায়?’’ রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়েছে গত ৮ জুন। আগামী ৮ জুলাই রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট। বাংলায় ত্রিস্তর গ্রাম পঞ্চায়েতের মোট আসন সংখ্যা ৬৩ হাজার ২২৯টি। পঞ্চায়েত সমিতি আসন ৯,৭০৩। আর ২০টি জেলা পরিষদে মোট আসন ৯২৮টি। সব মিলিয়ে ভোটগ্রহণ হবে ৭৩,৮৮৭ আসনে।

রাজ্য বাহিনী পাঠানোর নির্দেশিকা

রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে ২২ জেলার জন্য ২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। সেই মতো বাহিনী পাঠানোর নির্দেশিকা দিয়েছে কেন্দ্র। এই ২২ কোম্পানির মধ্যে রয়েছে বিএসএফের ৮, সিআরপিএফের ৬, এসএসবির ৪ এবং আইটিবিপির ৪ কোম্পানি। এই ২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন যাতে সুষ্ঠু ভাবে হয় সেই জন্য এস সি বুদাকোটিকে নোডাল অফিসার হিসাবে রাজ্যে নিযুক্ত করেছে কেন্দ্র।

আরও পড়ুন
Advertisement