কাঁথিতে অভিযুক্ত সংস্থার অফিস। — নিজস্ব চিত্র।
এ যেন ঠিক ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’। যিনি ভর্তি হবেন, তাঁকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে হবে না। সে জায়গায় অন্য কেউ পরীক্ষা দেবেন। অবশ্য তার জন্য দিতে হবে মোটা টাকা। ৬০-৬২ লাখ! তবে ‘গ্যারান্টি’ একশো শতাংশ।
অভিযোগ, মেডিক্যালের সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা বা ‘নিট’-এ এই ভাবেই ভর্তির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে একটি সংস্থা। ‘মুশকিল আসান কেন্দ্র’। যাদের আগে নাম ছিল ‘দিভজ্যোত এডুকেয়ার।’ সংস্থার প্রধান শাখা পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি শহরে। বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, হাওড়ার মতো একাধিক জেলা থেকে এই সংস্থার নামে অভিযোগ পেয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার তরফ থেকে পরিচয় গোপন রেখে গত শুক্রবার সকালে যাওয়া হয়েছিল এদের দফতরে।
কী হয়েছিল তার পরে? এক ছাত্রীকে বিনা নিট-এ কলকাতার এক সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ব্যাপারে ৬২ লক্ষ টাকায় রফা হয়। সংস্থার কর্ণধার সব্যসাচী পণ্ডা নির্বিকারে বলেছিলেন, ‘‘কাজটা বেআইনি, জানি। কিন্তু এতে অনেক ছাত্রছাত্রীর উপকারও হয়। রাজ্যের প্রায় সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অনেক অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। তাঁদের সাহায্য নিয়েই চালিয়ে যাচ্ছি!’’
‘মুন্নাভাই’ ছবিতে মুন্নাভাইয়ের জায়গায় পরীক্ষা দিয়েছিলেন মেডিক্যাল কলেজের এক ডাক্তার। এ ক্ষেত্রেও পদ্ধতি এক। সব্যসাচী বলেন, ‘‘২০০৫ থেকে এই কাজ করছি। ডামি ক্যান্ডিডেট রয়েছে আমাদের। তারা কেউ ডাক্তার বা ডাক্তারি পড়ছে। টাকা নিয়ে অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিয়ে দেবে।’’ কিন্তু ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মুন্নাভাই’-এর সময়ে বায়োমেট্রিক পরীক্ষা হত না। এখন হয়। আঙুলের ছাপ লাগে। মুখের ছবিও মিলিয়ে দেখা হয়। সে সব বাধা উতরোন করেন কী ভাবে— এই প্রশ্নের জবাবে সব্যসাচী দাবি করেন, ‘‘ছবিতে একটু কারিকুরি করে দেব অথবা আসল ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে মুখের মিল বা হাতের ছাপের মিল করাতে প্লাস্টিক সার্জারিও করিয়ে দেব! এটা আমাদের দায়িত্ব।’’ এর সঙ্গে জুড়ে দেন একটি শর্ত, ‘‘তবে আসল প্রার্থীকে পরীক্ষার দিন কোনও ভাবে বাড়িতে রাখা যাবে না। দূরে কোথাও সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’’ কেন? সব্যসাচীর কথায়, ‘‘আশপাশে আত্মীয়-বন্ধু-প্রতিবেশী, কারও যাতে সন্দেহ না হয়।’’
পরে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরে অবশ্য সব্যসাচী পণ্ডার দাবি, ‘‘আর এ কারবার করব না। আজই অফিস বন্ধ করে দেব।’’
সত্যিই কি এ ভাবে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে তারা ছাত্র ভর্তি করেছে? সব্যসাচীর দাবি, কলকাতার তারাতলায় এক ব্যবসায়ীর ছেলেকেও বছরখানেক আগেই এ ভাবে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। কাঁথি শহরের এক যুবককে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করেছেন। শুক্রবার বিকেলে সেই যুবকের বাড়িতে গিয়েও দেখা করা হয়। তিনিও বলেন, ‘‘সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পুরোটাই ‘মুশকিল আসান’ করে দিয়েছে। তার জন্য আমাকে পরীক্ষায় বসতে হয়নি। তবে আমি মেডিক্যাল পড়া শেষ করতে পারিনি ব্যক্তিগত কিছু কারণে।’’
যদিও সাগর দত্ত কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এই রকম কোনও ছাত্রের কথা তাঁরা মনে করতে পারছেন না। রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা কৌস্তভ নায়েকের কথায়, ‘‘এই ধরনের ভুয়ো সংস্থা মানুষকে টোপ দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে প্রতারণা করে। কোনও ভাবেই এরা কাউকে সরকারি জায়গায় ভর্তি করতে পারে না।’’ কাঁথির মহকুমাশাসক শৌভিক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘শহরের বুকে এমন ব্যবসা চলছে, জানতাম না। খোঁজ নিয়ে দেখছি।"
২০২২ সালের জুলাইয়ে সিবিআই দিল্লিতে ঠিক এই ধরনের মেডিক্যালে ভর্তির এক চক্র ফাঁস করে। সেখানেও আসল প্রার্থীর বদলে ২০ লক্ষ টাকা নিয়ে ‘ডামি’ প্রার্থীর ব্যবস্থা করা হত নিটের জন্য। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্রে বিস্তৃত ছিল সেই চক্রের জাল।
চলতি বছর নিট হতে চলেছে ৫ মে। ১৬ মার্চ ফর্ম পূরণ শেষ। একাধিক জেলার যে সব অভিভাবক বা ছাত্রছাত্রীদেরসঙ্গে এই ‘মুশকিল আসান কেন্দ্র’-র যোগাযোগ হয়েছে, তাঁদের অনেকেরই অভিযোগ, বিভিন্ন জেলার বড়-বড় স্কুলকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন ‘টার্গেট’ করে সেই স্কুলের সামনে সংস্থার তরফে লিফলেট বিলি করা হয়। যাঁরা আগ্রহ দেখান এবং ফোন নম্বর দেন, তাঁদের সঙ্গে সংস্থার কর্মীরা যোগাযোগ শুরু করেন। অভিযোগ, টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে, দিনরাত ফোন আর মেসেজ শুরু হয়।
কেউ রাজি হলে টাকা দেওয়ার বিষয়টিও অভিনব। সব্যসাচী পণ্ডা জানান, টাকা তাঁর অ্যাকাউন্টে দেওয়ার পরে তিনি স্ট্যাম্প পেপারে লিখিয়ে নেবেন যে, ওই টাকা তিনি আগে ধার হিসাবে দিয়েছিলেন। সেটাই এখন ফেরত পেলেন! যেখানে তাঁদের অফিস চলে, সেই ঘরের মালিক সমিত দিন্দা বলেন, ‘‘মুশকিল আসান কেন্দ্র নামে ট্রেড লাইসেন্স দেখিয়ে সব্যসাচীর ছেলে দেবাশিস ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন।’’