হত শনিবারের ম্যাচে পেত্রাতোস। —ফাইল চিত্র।
যখন থেকে বোধ হয়েছে, বুঝে গিয়েছেন শুধু ফুটবলই খেলবেন। তাই জীবনে কোনও ‘প্ল্যান বি’ ছিল না। সেই অর্থে তাঁর এগিয়ে চলাটা পরিকল্পনাহীন। যখনই সময় পেয়েছেন, শুধু চুটিয়ে ফুটবল খেলেছেন। এই খেলাকে আঁকড়ে ধরে বেড়ে ওঠা দিমিত্রি পেত্রাতোস এখন নিঃসন্দেহে ভারতের এক নম্বর ফুটবল তারকা।
মঙ্গলবার বিকেলে অনুশীলনে নামার আগে মোহনবাগান মাঠে যখন সাক্ষাৎকার দিতে বসলেন, বার বার উঠে এল ফুটবলকে ভালবেসে ফেলার গল্প। তাই এই মরসুমে একটু পিছন থেকে খেলতে হওয়ায় গোল পাচ্ছেন না বলেও কোনও আক্ষেপ নেই। গত মরসুমে ১০ গোল করা পেত্রাতোস মাঠে নামলেই খুশি। তবু ফুটবলে তো গোলটাই সব। তাই মেসির সঙ্গে খেলতে ভাল লাগবে, না রোলান্ডোর সঙ্গে— এই প্রশ্নের জবাবে প্রথম জনকে বেছে নিলেন। বললেন, ‘‘মেসির পাশে খেলতেই ভাল লাগবে। কারণ মেসি এখন একটু পিছন থেকে খেলে। তাই গোলের পাস পাব। রোনাল্ডোকে কিন্তু আমাকেই বলের জোগান দিতে হবে।’’ হাসি সরিয়ে পর ক্ষণেই বললেন, ‘‘আমি ফুটবলার। যে কোনও জায়গায় খেলতে তৈরি। কোচ যদি পিছন থেকে খেলান, খেলাতে পারেন। আমার উইং বা মাঝমাঠে খেলতেও আপত্তি নেই। আমার কাজ হল শুধু খেলা।’’
গত বছর মোহনবাগানের আইএসএল জয়ের নেপথ্যে জেসন কামিংসের সঙ্গে পেত্রাতোসের জুটির অবদানই সবচেয়ে বেশি। দল যে ৪৭টি গোল করেছিল, তার মধ্যে এই দু’জনই করেছিলেন ২২টি। এ বার কামিংসকে প্রথম দলে পাচ্ছেন না। কারণ, দলে তৃতীয় অস্ট্রেলীয় জেমি ম্যাকলারেন এসে গিয়েছেন। তিনিই মূলত শুরু থেকে খেলছেন পেত্রাতোসের সঙ্গে। অসুবিধা হচ্ছে না? পেত্রাতোস বললেন, ‘‘তফাত অবশ্যই আছে। সেটাই স্বাভাবিক। নতুন কিছু হলে সেটা থিতু হতে সময় লাগে। যত খেলব, আমাদের বোঝাপড়া তত বাড়বে। আমরা দল হিসাবে খেলি। কে খেলল, কে খেলল না, সেটা আলাদা করে তফাত তৈরি করে দেয় না।’’
হুয়ান ফেরান্দো, আন্তোনিয়ো হাবাস, হোসে মোলিনা— মোহনবাগানে তিন জন কোচের অধীনে খেলা হয়ে গিয়েছে পেত্রাতোসের। কারও সময়ে পিছন থেকে খেলতে হয়েছে, কারও সময়ে প্রথম একাদশে সুযোগ হয়নি, নেমেছেন পরে। রিজ়ার্ভ বেঞ্চে বসে থাকাটা কঠিন জানিয়েও তিনি বললেন, ‘‘সব কোচের নিজস্ব ঘরানা, পদ্ধতি থাকে। আসল হল দল ভাল খেলছে। গত বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এ বার এখনও শীর্ষে আছি। এটাই গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ, বেঞ্চে বসে থাকাটা কঠিন। শুধু মানসিক দিক থেকে কঠিন, তা নয়। পরে নেমে খেলাটাই কঠিন। যখন পরে নামছি তত ক্ষণে দল একটা গতি, ছন্দের মধ্যে চলে এসেছে। সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। তাতেই খানিকটা সময় চলে যায়। না পারলে গোটা দলকে ভুগতে হয়। শুরু থেকে খেললে এই মানিয়ে নেওয়ার কাজটা করতে হয় না।’’
এখন সমর্থকদের তাঁকে নিয়ে বাড়তি আগ্রহ। কারণ, অস্ট্রেলিয়ায় ছুটি কাটাতে গিয়ে ফিরেছেন ভোল বদলে। ঘন কালো চুল এখন ছোট করে ছাঁটা। তাতে সোনালি রং। ‘নতুন’ দিমিকে নিয়ে তাই সেলফি তোলার ধুম। জানালেন, হঠাৎ মনে হয়েছে, তাই চুলে রং করেছেন। ভারতে খেলতে এসে কতটা উপভোগ করছেন, সেটা বলতে গিয়ে বার বার বললেন সমর্থকদের কথা। তাঁর ‘স্টেনগান সেলিব্রেশন’ বা ঊরুতে চাপড় মেরে উচ্ছ্বাস করাও সমর্থকদের কথা ভেবেই। বললেন, ‘‘সনি নর্ডি দলের হয়ে গোল করে স্টেনগান চালানোর মতো উচ্ছ্বাস করতেন। সমর্থকদের কাছেই শোনা। এক দিন কয়েক জন আবদার করলেন, আমিও যদি ও রকম করি। ব্যস, তখন থেকেই শুরু। আর ঊরু চাপড়ানোটা কিছু না ভেবেই। একটা ম্যাচে করেছিলাম। দেখলাম সাপোর্টাররা চাইছেন। কামিংসকেও দলে ভিড়িয়ে নিই। তবে কী উচ্ছ্বাস করব, সেটা পুরোটাই নির্ভর করে খেলার ফলের উপর। দু’গোলে পিছিয়ে থেকে যদি একটা গোল করি, নিশ্চয়ই লাগামছাড়া উচ্ছ্বাস করব না।’’
মরসুম শেষে কি তাঁকে লাগামছাড়া উচ্ছ্বাস করতে দেখা যাবে? মোহনবাগান কি আবার চ্যাম্পিয়ন হবে? তিনি কি সর্বোচ্চ গোলদাতা হবেন? ও সব ভাবছেনই না। বললেন, ‘‘একটা একটা ম্যাচ ধরে এগোতে চাই। এখনও ১৬টা ম্যাচ বাকি। প্রত্যেক মরসুমে আমরা এই ভাবেই খেলি। আর আমি ক’টা গোল করলাম, সেটা সত্যিই কোনও বিষয়ই নয়।’’ বাকি ১৩টি দলের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ কারা জানতে চাইলে পেত্রাতোস বললেন, ‘‘বিপক্ষকে নিয়ে ভাবতে যাব কেন? অন্য দলের উপর ফোকাসই করব না। কারা দ্বিতীয় স্থানে আছে, সেটা নিয়ে ভাবতে চাই না। আমরা এক নম্বরে আছি।’’ কোন ডিফেন্ডারকে টপকানো সবচেয়ে কঠিন? জবাব, ‘‘সামনে যে থাকবে তাকেই টপকানোর চেষ্টা করব।’’
এমনকি ডার্বি নিয়েও মাথা ঘামাতে চান না। বললেন, ‘‘জানি সমর্থকদের কাছে এই ম্যাচের আলাদা তাৎপর্য আছে। কিন্তু আমার কাজ সব ম্যাচে নিজের সেরাটা দেওয়া। সব ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও গোল করতে চাই।’’ ডার্বি নিয়ে আলাদা উচ্ছ্বাস না থাকাটা কি ইস্টবেঙ্গলের খারাপ পারফরম্যান্সের কারণে? পেত্রাতোস বললেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গল খুবই ভাল দল। ওরা কেন ভাল খেলতে পারছে না জানি না। সেটা বিচার করতে বসব না।’’
সেরা গোল অবশ্য বাছলেন গত বছর ডুরান্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ম্যাচ জেতানো গোলটাই। ১০ জনের মোহনবাগানকে ওই ম্যাচে জিতিয়েছিলেন পেত্রাতোস। বললেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে গোল বলে বলছি না। ফাইনালে গোল করার মজাই আলাদা।’’ পাশাপাশি রাখলেন গোয়ার বিরুদ্ধে থ্রো-ইন থেকে করা গোল।
ইস্টবেঙ্গল কেন ভাল খেলতে পারছে না, সেটা যেমন বুঝতে পারছেন না, তেমনই মাথায় ঢুকছে না, কেন ভারতীয় ফুটবল পিছিয়ে রয়েছে। বললেন, ‘‘সুযোগ পেলেই বাচ্চাদের সঙ্গে রাস্তায় খেলতে নেমে পড়ি। ওটুকুতেই বুঝি, এ দেশে প্রতিভার অভাব নেই। ব্রাজিলেও তো এ ভাবেই ছোটরা খেলা শুরু করে। সেই রাস্তায় বা মাঠেই তো ওরা খেলে। কিন্তু স্ট্রিট ফুটবল থেকে পেশাদার ফুটবলে উত্তরণের মাঝের পর্বটাই আসল। সেখানে একটা সিস্টেম কাজ করে। ভারতে এই সিস্টেমটা ঠিক কী, সেটা আমি জানি না।’’
পেত্রাতোস আসলে গ্রিক। তবে জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়। বাবা অ্যাঞ্জেলো সিডনি অলিম্পিক এফসি-র ডিফেন্ডার ছিলেন। দুই ভাই কোস্তা আর মাকি, এমনকি দুই বোন পানাইয়োতা এবং আনাস্তাসিয়াও ফুটবল খেলেন। বলেই দিলেন, ‘‘আমার পরিবারের প্রত্যেকেই কোনও না কোনও সময়ে কোনও না কোনও স্তরে ফুটবল খেলেছে। তাই আমিও ফুটবল ছাড়া আর কিছু ভাবিনি।’’ অবসর সময়েও তাই ফুটবল নিয়েই থাকেন। বললেন, ‘‘হোটেল থেকে বেরিয়ে মাঝেমাঝেই বাচ্চাদের সঙ্গে রাস্তায় খেলতে নেমে পড়ি। যুবভারতীতে ৬০ হাজার লোকের সামনেই খেলি বা ওদের সঙ্গে খেলি, প্যাশনটা একই থাকে। ভবিষ্যৎ নিয়ে বাচ্চাদের ভাবনা নেই। মনের সুখে ওরা বর্তমানটা উপভোগ করে। এটা একটা শিক্ষা।’’
সময় কাটে ছবি এঁকেও। পেনসিল স্কেচ করে মোবাইলে তিনি পাঠিয়ে দেন সন্তানদের কাছে। তাতে রং করে তারা আবার পাঠিয়ে দেয় বাবার কাছে। ‘পিস’, ‘ফুটবল ইজ়় ফ্রিডম’ লেখা হাতভর্তি ট্যাটুতে রয়েছে সন্তানদের নামও। শেন ওয়ার্নের ভক্ত পেত্রাতোস অবসর সময়ে ক্রিকেটও খেলেন, তালিকায় রয়েছে টেনিস, গল্ফও।