Igor Stimac

ফুটবল নিয়ে আগ্রহী নন ফেডারেশন কর্তারাই, আইএসএল কোনও লিগই নয়! বললেন বরখাস্ত কোচ স্তিমাচ

ভারতীয় দলের কোচের চাকরি হারিয়ে ফেডারেশন কর্তাদের তোপ দাগেন স্তিমাচ। পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় নানা অভিমান, অনুযোগ শোনা গিয়েছে তাঁর মুখে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২৪ ১৭:১৭
India’s former football coach Igor Stimac speaks about his five years’ experience and slams AIFF

ইগর স্তিমাচ। —ফাইল চিত্র।

বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বের তৃতীয় রাউন্ডে ভারত পৌঁছতে না পারায় বরখাস্ত করা হয়েছে কোচ ইগর স্তিমাচ। সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের (এআইএফএফ) এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি পরামর্শ নিচ্ছেন স্তিমাচ। তার মধ্যেই শুক্রবার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললেন গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে।

Advertisement

কোথায় পিছিয়ে ভারতীয় ফুটবল? প্রতিভা, পরিকাঠামো না পরিকল্পনা? আনন্দবাজার অনলাইনের এই প্রশ্নের জবাবে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে স্তিমাচ বললেন, ‘‘ভারতে প্রতিভা নেই, তা নয়। কিন্তু এত বড় দেশে ফুটবলের উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। ভারতে অনেক জায়গা রয়েছে, যেখানে ফুটবল খেলার একটা ক্লাব নেই। একটা ভাল মাঠ নেই। অথচ সে সব এলাকার অনেকে ফুটবল খেলতে চায়। জাতীয় দলের কোচ থাকায় আমার কাছে অনেকে সাহায্য চাইত। সমাজমাধ্যমে যোগাযোগ করত। সপ্তাহে এক দিন করে সমাজমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট দেখতাম। অসংখ্য এমন অনুরোধ জমে থাকত। কিন্তু তাদের সাহায্য করার মতো কোনও সুযোগ আমার ছিল না। আর পরিকল্পনার কথা কী বলব? এআইএফএফের তো কোনও ভাবনা-চিন্তাই নেই ফুটবল নিয়ে।’’

কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে আপনাকে ভারতীয় দলের কোচ হিসাবে? এই প্রশ্নের জবাবে এক রাশ অভিযোগ, অভিমান শোনা গিয়েছে স্তিমাচের মুখে। এ দিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় ভারতীয় দলের অ্যাওয়ে জার্সি পরেছিলেন স্তিমাচ। তাঁর অভিযোগের একটা বড় অংশ এআইএফএফ এবং সংস্থার সভাপতি কল্যাণ চৌবের বিরুদ্ধে। তাঁর বক্তব্য,‘‘কল্যাণকে রাজনৈতিক ভাবে এই পদে বসানো হয়েছে। যদিও ওর কোনও রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই। কলকাতার বাইরে তেমন পরিচিতি নেই। জাতীয় দল নিয়ে কোনও ভাবনা নেই। তবে ফুটবল-বিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করতে ভালবাসে। ও সভাপতি হওয়ার কয়েক মাস পর কলকাতার এক হোটেলে প্রথম দেখা হয়েছিল। ৩ মিনিটও কথা হয়নি দু’জনের। তার মধ্যে অন্তত পাঁচ বার ঘড়ি দেখেছিল। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম, জাতীয় দলের কোচ সম্পর্কে ওর কী মনোভাব। এর কয়েক মাস পর দ্বিতীয় বার দেখা হয়েছিল। সে বারও খুব অল্প কথা হয়েছিল। মূলত আমিই বলেছিলাম। জানি না কতটা গুরুত্ব দিয়ে শুনেছিল। জাতীয় দল নিয়ে আমার সঙ্গে নিজে থেকে কখনও কথা বলেননি ফেডারেশন সভাপতি।’’

আক্ষেপ নিয়ে স্তিমাচ বলেছেন, ‘‘গত বছর ২৬ জুলাই ফেডারেশনকে লিখিত ভাবে জানিয়েছিলাম ভারতীয় দলের পরিস্থিতি, সম্ভাবনার কথা। কী কী করা উচিত বলেছিলাম। ছ’সপ্তাহ অপেক্ষা করেও উত্তর পাইনি। জানি না এআইএফএফ আদৌ ভারতীয় ফুটবল নিয়ে আন্তরিক কিনা। যখনই কোনও সাহায্যের কথা বলেছি, সব সময় আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবে কিছুই করা হয়নি। একটা ভিডিয়ো ক্যামেরা চেয়েছিলাম। অনুশীলনের কিছু অংশ ধরে রেখে পরে পর্যালোচনার জন্য। সেটাও দেওয়া হয়নি। বিদেশে অনেক ভারতীয় বংশোদ্ভুত ফুটবলার রয়েছে। তাদের অনেকে ভারতের হয়ে খেলতে ইচ্ছুক। অথচ ফেডারেশনের কোনও উদ্যোগ নেই। টেকনিক্যাল কমিটির এক জনকে দলের সঙ্গে রাখতে অনুরোধ করেছিলাম। তা হলে দলের কাজ, প্রস্তুতি, খামতি, প্রয়োজন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা তৈরি হতে পারত। তাও করা হয়নি। কিছুটা হতাশ হয়ে গত বছরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সরে যাওয়ার। তখন আমার সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করা হয় ২০২৬ পর্যন্ত। অবাক হয়েছিলাম। তবে প্রস্তাব পেয়ে ভারতীয় ফুটবলের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলাম। বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম এআইএফএফকে। সেটাই আমার সব থেকে বড় ভুল ছিল। কর্তারা শুধু মিথ্যা আশ্বাস দেন। অনুরোধ করেছিলাম, জাতীয় দলে আমার সহকারীদের সঙ্গেও চুক্তি করতে। শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। জানি না কেন!’’

ভারতীয় দলের পারফরম্যান্স নিয়ে খুশি স্তিমাচ। গর্বিত ফুটবলারদের নিয়ে। তাঁর পরিষ্কার কথা, ‘‘গত বছর কিংস কাপ, মারডেকা কাপ এবং শেষ কাতার ম্যাচে আমাদের সঙ্গে ডাকাতি করা হয়েছে। এত জঘন্য রেফারিং আন্তর্জাতিক ফুটবলে আশা করা যায় না। ছেলেরা ভাল খেলেও তার ফল পায়নি। অথচ জাতীয় দলের স্বার্থে এআইএফএফ কিছুই করেনি। ফেডারেশন জাতীয় দলকে, ফুটবলারদের রক্ষা না করলে কে করবে! আমি নিজে ছেলেদের পাশে দাঁড়িয়ে লাল কার্ড দেখেছি। সবার মনে আছে। ছেলেদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। নিজেকে উদাহরণ তৈরি করে ফেডারেশন কর্তাদের শেখানোর চেষ্টা করেছি। তাঁরা কিছুই শেখেননি। উল্টে আমার সমালোচনা করেছেন! অনেক বার বলেছি, টেকনিক্যাল কমিটির আসলে সমস্যার জায়গাগুলো কখনও বোঝার চেষ্টাই করেননি কর্তারা।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘জাতীয় দল যখন একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তখনই দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই ঘটনাটা ঘটল। এআইএফএফ কর্তারা হঠাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। অথচ আমার সঙ্গে চুক্তিতে বরখাস্ত করার প্রসঙ্গে কিছু লেখা নেই। এটা নিয়ে কথা বলতে চাই না। বিষয়টা আইনজীবীর উপর ছেড়ে দিয়েছি। তবে আমার দল যা অর্জন করেছে, তাতে আমি খুশি। ছেলেদের জন্য গর্বিত। আমরা আরও আগ্রাসী, ইতিবাচক এবং সংগঠিত ফুটবল খেলার দিকে এগোচ্ছিলাম। ছেলেরা চেষ্টা করছিল নিজেদের পরের পর্যায়ে নিয়ে যেতে। সেই পদ্ধতিটা ধাক্কা খেল ফেডারেশনের এই সিদ্ধান্তে।’’ স্তিমাচের অভিমান, জাতীয় দলের প্রস্তুতির জন্য কখনও পর্যাপ্ত সময় বা সুবিধা পাননি। সব সময়ই মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়েছে তাঁকে। জাতীয় দল নিয়ে ফেডারেশনের সদর্থক মানসিকতা দেখিনি। বিশেষ করে কর্তাদের মধ্যে। কিছু কর্মী সব সময় চেষ্টা করেছেন জাতীয় দলকে যতটা সম্ভব সাহায্য করার। বিশেষ করে আমার দলের ম্যানেজারের কথা বলব। দুর্দান্ত মানুষ। কী পরিশ্রমটাই না করেছেন। সব সময় সতর্ক থাকতেন। ফুটবলার বা আমার সহকারীদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, খেয়াল রাখতেন। আমি যা কিছু চেয়েছি, সব ভারতীয় ফুটবলের জন্য। নিজের জন্য কিছুই চাইনি। তাও পাইনি। এটাই আমাকে সব থেকে বেশি হতাশ করেছে। না কারও উপর আমার রাগ নেই। আসলে এ ভাবে ফুটবল হয় না। জাতীয় দলের প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয় না। প্রাক মরসুম প্রস্তুতির সুযোগ নেই। ফুটবলারেরা নিজেদের উন্নতির জন্য কোনও সময় পায় না। উন্নতি হবে কী করে!

তিনি আরও বলেছেন, ‘‘ফেডারেশনের নির্বাচনের পর সব কিছু হঠাৎ পাল্টে গিয়েছে। আগে তবু একটা পরিকল্পনার ছাপ দেখতাম। পরে সব কিছুই উধাও হয়ে গেল! ‘‘সাজি প্রভাকরণকে হঠাৎ সরিয়ে দেওয়া হল। অথচ ও চেষ্টা করছিল। এখন যারা ফেডারেশনের ক্ষমতায় আছে, তাদের প্রায় সকলে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যস্ত। নিজেদের চেয়ার আগলাতে আগ্রহী শুধু। ভারতীয় দলের স্বার্থ তাদের কাছে প্রাধান্য পায় না। ফুটবলের জন্য কিছুই করেন না অধিকাংশ কর্তা। টেকনিক্যাল কমিটিও কাজের নয়। আইএম বিজয়ন ছাড়া কারও আন্তরিকতা দেখিনি।’’

স্তিমাচ খুশি নন ইন্ডিয়ান সুপার লিগ নিয়েও। ভারতীয় দলের সদ্য প্রাক্তন কোচের বক্তব্য, ‘‘এটা কোনও প্রতিযোগিতাই নয়। এত দিন ধরে একটা প্রতিযোগিতা চলছে, অথচ অবনমন নেই। দেশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা কেন একটা কর্পোরেট সংস্থা চালাবে? ফেডারেশনের আয়োজন করা উচিত। তা হলে ফেডারেশনের কাজটা কী? পৃথিবীর কোথাও এ ভাবে ফুটবল হয় না। শুধু ভারতে হয়। একটা ক্লাব নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিতে না পারলে খেলতে পারবে না! তাদের সাফল্যের কোনও গুরুত্ব নেই? ফুটবলারেরা কী করে ভাল খেলার উৎসাহ পাবে। অবনমন নেই। জানি না কী ধরনের চুক্তি রয়েছে। ফুটবলারেরা ভাল টাকা পাচ্ছে। ভাল হোটেলে থাকছে। বিমানে যাতায়াত করছে। মাঠগুলো ভাল। এটুকুই ভাল আইএসএলের। এটা কোনও ফুটবল নয়। বিদেশি ফুটবলার নির্ভর করে ফেলা হয়েছে। এ ভাবে ফুটবলের উন্নতি হয় না।’’ আপনি কেন দেখতেন না আইএসএলের ম্যাচ? স্তিমাচের উত্তর, ‘‘প্রথম দিকে মাঠে যেতাম। কিন্তু দলে দলে লোক আসত ছবি তুলতে বা সই নিতে। খেলাটাই দেখতে পারতাম না। জাতীয় দলের কোচের বসার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা নেই। যে কাজটা করতে যেতাম, সেটা মাঠে গিয়ে করা সম্ভব হত না। তাই টেলিভিশনে খেলা দেখতাম। ঘরে বসে নিজের কাজটা অন্তত করতে পারতাম। আইএসএলের কোচদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম প্রয়োজন মতো। জাতীয় দলে খেলতে পারে এমন ছেলেদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতাম।’’

কী ভাবে এগোতে পারে ভারতীয় ফুটবল? স্তিমাচের বক্তব্য, ‘‘এখন ভারতীয় ফুটবলের অবস্থা জেলবন্দির মতো। ২০ বছর দরকার অন্তত। এই সময়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। অন্তত তিনটে প্রজন্মকে উন্নত মানের প্রশিক্ষণ দিতে হবে প্রথম থেকে। তা হলে একটা জায়গায় পৌঁছতে পারে ভারতীয় ফুটবল। না হলে কিছুই হবে না।’’ বরখাস্ত হলেও স্তিমাচ ভারতীয় ফুটবলের সমর্থক থাকবেন। জাতীয় দলের খেলায় নজর রাখবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘সুনীল ছেত্রীর বিকল্প পাওয়া সম্ভব নয়। দল হিসাবে ওর অভাব ঢাকতে হবে। সেটা কাতারের বিরুদ্ধে ম্যাচে আপনারা দেখেছেন। সুনীল নির্ভরতা কাটিয়ে ছেলেরা কী ভাবে নিজেদের খেলা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। অবসরের সিদ্ধান্ত ওর ব্যক্তিগত। আমাকে আগেই জানিয়েছিল। ওর অভাব নির্দিষ্ট কাউকে দিয়ে পূরণ সম্ভব নয়।’’

জীবনের প্রথমবার বরখাস্ত হয়ে বিস্মিত স্তিমাচ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার সঙ্গে ফেডারেশন সচিবের কথা হয়েছিল। দু’তিন সপ্তাহ সময় চেয়েছিলাম। নিজেই সরে যাব ভেবেছিলাম। তা হলে আমি কোনও বেতনও চাইতাম না। এক দু’মাসের টাকা দিলেই এআইএফএফের মিটে যেত। এখন ভারতীয় দলের কোনও খেলা নেই। এটুকু সময় নিতেই পারত। তাতে ফেডারেশনের সুবিধা হত। অথচ কথা হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই আমাকে বরখাস্তের চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হল। এখন বিষয়টা আমার আইনজীবী দেখবেন। কতটা টাকা পাব হিসাব করিনি।’’

কী করবেন এখনও সিদ্ধান্ত নেননি। আপাতত ইউরো কাপে ক্রোয়েশিয়াকে সমর্থন করবেন। খেলা দেখবেন। তার পর সিদ্ধান্ত নেবেন। জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর কাজে অভাব নেই। একাধিক প্রস্তাব রয়েছে।

আরও পড়ুন
Advertisement